কিন্তু সেই লাল-মাথা ছেলেটা আবার লেখা শুরু করে দিলেন, আর তখন থেকেই আধডজন সবচাইতে বেশি জনপ্রিয় ও মূল্যবান উপন্যাস চটপট লিখে ফেললেন এবং সবাইকে অবাক করে দিলেন। অবশ্য চটপট বললে ভুল হবে কারণ তিনি অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং ধৈর্য সহকারে তার পাণ্ডুলিপিগুলো সমাপ্ত করেন। তার মেইন স্ট্রিট’ প্রকাশের সতের বছর আগে তা লিখতে আরম্ভ করছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘উডসওয়ার্থ র্যাবিট’, ‘এ্যারোস্মিথ, এলমার গাট্রি’, এ্যান ভিকারস’, ‘ইট কান্ট হেপেন হিয়ার’ ইত্যাদি।
আমি একবার তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা বলতে বলেছিলাম। তিনি বলেছেন যে, যদি কোনো সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত না থাকেন তাহলে তখন হয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক অথবা দর্শন শেখানোর কাজ নতুবা গভীর জঙ্গলে গিয়ে একদল করাতীর সাথে বসবাস করা তিনি পছন্দ করেন। বছরে ছয় মাস তিনি পার্ক অ্যাভিনিউতে কাটাতে ভালোবাসেন আর বাকি ছয় মাস ভারমন্ট পাহাড়ের একটা নির্জন স্থানে বসে কাটান। সেখানে তিনশত চল্লিশ একরের একটা আখচাষের খামার আছে তার। তিনি নিজের শাকসবজি সেখানে ফলান। শুধুমাত্র চুল কাটানোর প্রয়োজন হলে তিনি শহরে যান।
তাঁর মতে কারো বিখ্যাত হওয়াটা বড় বিরক্তিকর। তিনি আমাকে বললেন, যদি তিনি লোকদের সমস্ত চিঠির উত্তর দিতেন তা হলে তিনি আর কোনোদিনই আর একটা বইও লিখতে সক্ষম হতেন না। শুধু তাই নয়, তা হলে তার ঘুমোবার সময়টাও ভাগ্যে জুটত না। তাই তিনি অধিকাংশ চিঠি অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে সেগুলোকে পুড়ে যেতে দেখতেন। তিনি অটোগ্রাফপ্রার্থীদেরকে এড়িয়ে চলতেন। কদাচিৎ ভোজসভায় যেতেন এবং সাহিত্যিকদের আলোচনায় চা চক্র বর্জন করতেন।
আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম কীভাবে তিনি অনেক বছর প্রাতরাশের দুই ঘণ্টা আগে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে উনুন জ্বালাতেন, কফির পানি ফুটানোর জন্য চুলোয় কেটলি চড়িয়ে দিয়ে অবিরাম লিখে যেতেন। তিনি নিজের খাবার নিজেই রাঁধতেন, কাপড় ধুতেন এবং ছয় মাস যাবত দিন-রাত কাজ করতেন। এই ছ’মাসে তিনি একটিমাত্র জিনিস বিক্রি করলেন, তা হল দুই ডলারের বিনিময়ে একটি মাত্র কৌতুক। তিনি বলেছেন, তার যখন পেশায় হাতেখড়ি হচ্ছিল তখন ওই বছর ক’টিতে তার সময় যেমন কেটেছিল তেমনটি আর কখনো কাটে নি।
তাঁর লিখিতবইগুলোর কতকপি বিক্রি হয়েছে তা তিনি জানতেন না এবং তিনি কত উপার্জন করেছেন তারও হিসেব রাখতেন না।
তিনি সবরকমের অভিজ্ঞতাই অর্জন করতে সক্ষম হন! একবার তিনি গরু-ভেড়ার নৌকায় করে আটলান্টিক মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন। তিনি বধির বালকদের জন্য প্রকাশিত একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি ছোটদের জন্য কবিতা লিখতেন এবং জ্যাক লন্ডনের কাছে কবিতার ও গল্পের প্লট বিক্রি করতেন। তিনি খেলাধুলার প্রতি তেমন আকর্ষণ বোধ করতেন না। এমনকি বিখ্যাত খেলোয়াড়দের দু একজনের বেশি তার নাম জানা ছিল না। একসময় সিনক্লেয়ার লুইস যে পত্রিকাগুলোতে কাজ করতেন তার প্রথম চারটাই তাকে বরখাস্ত করেছিল। কোনো ব্যাপারে উপদেশ ও উৎসাহ প্রদানের প্রয়োজনীয়তা তিনি বিশ্বাস করতেন না।
সাহিত্যে নেবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এইখবর টেলিফোনে যখন তিনি পেলেন, তিনি তা বিশ্বাস করলেন না এবং হেসে উড়িয়ে দিলেন। তিনি ভাবলেন কেউ হয়তো তার সঙ্গে ঠাট্টা মসকরা করছে। অবশেষে তিনি যখন জানতে পারলেন তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন–তিনি সাহিত্য জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানলাভে সক্ষম হয়েছেন।
হাওয়ার্ড থার্সটন : একজন বিখ্যাত জাদুকর
প্রায় বছরেরও আগের কথা। আলেকজান্ডার হারম্যন-এর জাদু দেখে খুশিমনে শিকাগোর এক থিয়েটার হল থেকে ভয়ানক শীতের রাতে দলে-দলে দর্শকরা বের হয়ে আসছিল। তখনকার সময়ের শ্রেষ্ঠ জাদুকর ছিলেন হারম্যন।
থিয়েটার হলেন সামনে এক বালক রাস্তায় দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ বিক্রি করছিল। তার গায়ে কোনো ওভারকোট ছিল না, ঘর বাড়ি ছিল না এবং থাকার মতো জায়গাও ছিল না। লোকজনের ভিড় কমে যাওয়ার পর থিয়েটার হলের পেছনে শুয়ে পড়ল, সে দেহটাকে প্রচণ্ড শীত থেকে রক্ষার জন্য একটা লোহার ঝাঁঝরির ওপর খবরের কাগজ দিয়ে শরীরটাকে জড়িয়ে নিল। শুয়ে থাকতে থাকতে এই বালক প্রতিজ্ঞা করল, সে একজন বড় জাদুকর হবে এবং ফারের কোট গায়ে জড়িয়ে জাদু দেখাবে, লোকজন হাততালি দিয়ে তাঁর প্রশংসা করবে। সে আরো প্রতিজ্ঞা করল, সে একজন বিখ্যাত জাদুকর হয়ে এ থিয়েটার হলে জাদু দেখাবে এবং বড় বড় হরফে তার নাম ছাপা হবে। এই বালকটির নাম হাওয়ার্ড থার্সটন।
তিনি যা ভেবেছিলেন, বিশ বছর পরে তাই-ই করলেন। এই থিয়েটার হলে তিনি জাদু দেখাতে এলেন। অনুষ্ঠান শেষ করার পর থিয়েটার হলের পিছনে গেলেন এবং যে জায়গায় তিনি গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় শুয়ে-শুয়ে নিজের নামের আদ্যাক্ষরটা দেয়ালের গায়ে খোদাই করছিলেন, সেটা দেখালেন।
থার্সটনের ছেলেবেলায় তার বাবা একদিন তাকে নিষ্ঠুরভাবে মারলেন। থার্সটনের অপরাধ হল তিনি একদল ঘোড়াকে বেশি জোরে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। রাগে দুঃখে তিনি চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন, পাঁচ বছরে আর ফিরে যান নি। বাবা-মা ভেবেছিলেন, তিনি মারা গেছেন। এরপর তিনি কখনো বক্সগাড়িতে চড়ে, কখনো-বা ভিক্ষা করে, আবার কখনো চুরি করে তার দুঃখজনক দিনগুলো কাটালেন। বিভিন্ন অপরাধের জন্য তিনি অনেকবার গ্রেফতার হলেন এবং বহুবার ফেরারি আসামি হলেন। লোকে তাকে গালাগালি দিল, অভিশাপ দিল আবার লাথি মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিল। তিনি ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় ঘোড়সওয়ার হলেন।