কিন্তু সমারসেট মম্ এতে চমৎকৃত হলেন না বরং নিরুৎসাহ হয়ে স্পষ্টবাদী ব্রিটিশ কণ্ঠে ব্যক্ত করলেন এটা ব্যাধিগ্রস্ত একটা নাটক হতে পারে, প্রকৃতপক্ষে গ্রাহ্য করার মতো তেমন কিছু নয়।
কিন্তু বস্তুতপক্ষে যে নাটককে গ্রহণ করার মতো কিছু নয় বলে মম্ মনে করলেন অবশেষে তা-ই তাকে এনে দিল দু-লাখ ডলার। এ নাটক লেখার পর বেশ কয়েকজন প্রযোজক তা প্রত্যাখান করেন। তারপর মেম হ্যারিস নামে এক নাট্যকার এটা গ্রহণ করলেন এবং তিনি ইঙ্গেলস নামী এক তরুণী উঠতি অভিনেত্রীর জন্য স্যাডি টমসনের চরিত্রটি মনোনীত করলেন।
অবশেষে এই চরিত্রে বলিষ্ঠ ও প্রাঞ্জল অভিনয় করে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে যশস্বী হলেন। আর অভিনয়ে এ নাটক ব্রডওয়ের মঞ্চে ৪১৫ রজনী প্রদর্শিত হল।
সমারসেট মম্ বেশ কটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, তন্মধ্যে অফ হিউম্যান বণ্ডেজ, দ্য মুন এ্যাণ্ড সিন্স পেন্স এবং দ্য রেজাস্ এজ অন্যতম। কিন্তু তার সব চেয়ে বিখ্যাত নাটকটিই লেখেন নি তিনি। তাকে অভিহিত করা হয় একজন ক্ষণজন্ম ও প্রতিভাময় সাহিত্যিক হিসেবে। অথচ এই যশস্বী লেখকের জীবনের প্রথম অধ্যায় তিনি হতাশা, বঞ্চনা ও দারিদ্রতার অন্ধকার বলয়ে নিপতিত কখনো না খেয়েও থাকতে হয়েছে তাকে। জীবনের এগারোটি বছর আয় ছিল যার মোটে পাঁচশ’ ডলার, পরে সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ উপার্জিত হতে থাকল বছরে লাখ লাখ ডলার। আর সঙ্গে-সঙ্গে এসেছিল যশখ্যাতি। তিনি পত্রিকাতে একটা সম্পাদকীয় লেখার চাকুরি নিতে চেয়েছিলেন, পান নি। সেই ক্ষোভ আর হতাশার জন্যই, তাঁর ভাষায়, তাকে অবিরত লিখে যেতে হল যা তাকে এনে দিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
মম্ চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন। তার বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন তাকে ওষুধের ব্যবসা চালানোর। কিন্তু সাহিত্যসাধনার ক্ষেত্রে নিজের নামটি সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং সাহিত্যের পাতায় নাম লেখানোর অদম্য স্পৃহা তাকে নিরত করতে পারল না।
একবার লন্ডনের এক লেখকের একটি নাটক মঞ্চে ফ্লপ করল। নাট্যশালার কর্মকর্তা ঠিক ‘হিট’ করার মতো নয় অথচ চলনসই একটি নাটক খুঁজছিলেন। ডেস্ক হাতড়াতে হাতড়াতে পেয়ে গেলেন সমারসেট মম এর ‘লেডি ফ্রেডারিক’। নাটক হিসেবে এটা তেমন যুৎসই ও উপযুক্ত নয় বিধায় তিনি তা ড্রয়ারে রেখে দিলেন এক বছর। কিন্তু নাটকটি মঞ্চ করার সঙ্গে সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য অলৌকিক ব্যাপার ঘটে গেল, লেডি ফ্রেডারিক অসাধারণ মঞ্চসাফল্য অর্জন করে সারা লন্ডনে একটা হইচই ঘটিয়ে দিল। অস্কার ওয়াইল্ডের ঝকঝকে সংলাপের পর এমন আর নাটক ইংল্যান্ডবাসীকে এত সন্তুষ্ট করতে পারে নি।
ঠিক এর পরপরই লন্ডনের প্রতিটি নাট্যগোষ্ঠী থেকে নাটক উপহার দেয়ার জন্য সমারসেট মম-এর কাছে মুহুর্মুহু আবেদন আসতে লাগল। আর তিনি তাঁর লেখনীতে বোঝাই ডেস্ক খুঁজে খুঁজে পুরনো পাণ্ডুলিপিগুলো বের করতে থাকলেন; দু-এক সপ্তাহের মধ্যে তার বেশ ক’টি নাটক লন্ডনে আঁকজমকপূর্ণভাবে প্রদর্শিত হল এবং সফলতা ও খ্যাতি অর্জন করল। এর ফলে জোয়ারের জলের মতো রয়্যালটির স্বর্ণরাশি আসতে থাকল তার দুয়ার প্রান্তে। অবশেষে শুরু হয়ে গেল মম্-এর লেখার গ্রন্থের জন্য প্রকাশকদের মধ্যে উচ্চতর দর কষাকষির প্রতিযোগিতা। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নিয়ন্ত্রণ আসতে থাকল অজস্র।
মম্-এর লেখার পদ্ধতি ও স্বভাব ছিল ভিন্নতর। বিকেলে কিছু লেখার জন্য মস্তিষ্ক একটুও কাজ করত না। কোনো লেখা শুরু করার আগে সবসময় ঘণ্টাখানেক পাইপে ধূমপান করতেন এবং দর্শন শাস্ত্র পড়তেন। তারপর লিখে যেতেন অনর্গল।
এভাবে সমারসেট মম্ তাঁর সাহিত্যসাধনা ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে নিজ আসনটি প্রতিষ্ঠিত করলেন খ্যাতির শীর্ষস্থানে, বরণীয় হলেন মর্যাদাসম্পন্ন লেখক হিসেবে। তাঁর লেখনী চলমান বিশ্বের সাহিত্যানুরাগী পাঠকসমাজের জন্য রেখে গেল অপূর্ব নজির।
সিনক্লেয়ার লুইস : তিনি নোবেল বিজয়ী হলেন
সিনক্লেয়ার লুইসের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হল আজ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে। তিনি, আমি এবং আরো কয়েকজন লং আইল্যান্ডের ফ্রিপোর্টে মোটর বোট নিয়ে উইক-মাছ ধরার জন্য জলের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। ঐ সময় আমি টুপি খুলে রেড লুইসকে অভিবাদন জানিয়েছি কারণ তিনি কখনো সমুদ্র পীড়ায় ভুগতেন না। সমুদ্রের ঢেউ প্রবল বেগে নৌকাটাকে আন্দোলিত করত আর আমি টাল সামলাতে
পেরে পাটাতনে আছড়ে পড়তাম, কিন্তু দেখেছি, লুইস পটে আঁকা ছবির মতো স্থির বসে থেকে মাছ ধরতেন। আজো আমি সিনক্লেয়ার লুইসের উদ্দেশ্য টুপি খুলে সম্মান জানাই শুধু একজন মৎস্য শিকারী হিসেবে তার দক্ষতার জন্য নয়, অবিরাম ধারায় অনেকগুলি চমকপ্রদ ও অমর উপন্যাস লেখার জন্য। আর আপনি যদি ভাবেন এটা আবার একটা বাহাদুরী হল নাকি? তাহলে আপনিও একবার একটু চেষ্টা করে দেখুন।
সিনক্লেয়ার লুইস প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন ১৯২০ সালে। এর আগে তিনি ছয়টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন কিন্তু জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হননি। তাঁর সপ্তম উপন্যাস ‘মেইন স্ট্রিট’ সমগ্র জাতির ওপর দিয়ে একটা প্রবল টর্নেডোর মতো বয়ে গেল। মহিলা সংগঠনগুলি তাঁকে অকাট্য ভাষায় বকাবকি করল, ধর্মযাজকরা এটাকে নিন্দা করল এবং খবরের কাগজগুলো একযোগে এটাকে আমেরিকার জাতীয়জীবনের প্রতি চরম একটা অপমান বলে অভিহিত করল। এই উপন্যাসটি আমেরিকার সাহিত্য জগতে প্রচণ্ড যুদ্ধ বাধিয়ে দিল। আর এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ল তিনি হাজার মাইল দূরে সুদূর ইউরোপে। অবশেষে এই বইটাই তাকে একজন প্রথম সারির তারকায় পরিণত করে দিল। নিন্দুকেরা বলল, হয়েছে বটে চমৎকার, কিন্তু এই পুঁচকে ছোঁকরাটা আবার ওরকম করে লিখতে পারবে না মোটেও।