লিও টলস্টয় এবং তার চিন্তাধারা সম্পর্কে ২৩,০০০ বই এবং সাময়িকী ও খবরের কাগজে ৫৬,০০০ প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। তাঁর লেখা গ্রন্থাদির পরিমাণ ছিল একশত খণ্ড।
বিবাহিত জীবনে প্রথম কয়েকটি বছর তিনি ও তার স্ত্রী এত সুখী ছিলেন যে তারা সবসময় নতজানু হয়ে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে আনন্দময় জীবন সুখময় ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতেন। কিন্তু বেশ ক’বছর পরে তারা হয়ে গেলেন চরম অসুখী। তিনি পরে তার স্ত্রীর মুখ দর্শনেও ঘৃণাবোধ
করতেন এবং তার অস্তিম ইচ্ছে ছিল তার স্ত্রীকে যেন তাঁর সামনে আসার অনুমতি না দেয়া হয়।
টলস্টয়ের জীবনটা ছিল একটা ট্রাজেডি আর এই ট্রাজেডির কারণ হল তাঁর স্ত্রী। তাঁর স্ত্রী ধনসম্পদ, খ্যাতি ও বিলাসিতা পছন্দ করতেন কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন যে ধন-সম্পদ এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি হল একটা পাপস্বরূপ। তাঁর স্ত্রী বিশ্বাস করতেন শক্তির শাসনে আর তিনি বিশ্বাস করতেন ভালোবাসার শাসনে।
টলস্টয় সাহিত্যসাধনার ক্ষেত্রে প্রাচীন রাশিয়ার জার সম্রাটদের চেয়েও বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি তার বিখ্যাত উপন্যাস দুটো রচনার জন্য লজ্জিত হয়েছিলেন এবং অবশিষ্ট জীবন শান্তি, ভালোবাসা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে বাণীপূর্ণ পুস্তিকা প্রণয়নের ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। পুস্তিকাগুলো সুলভ সংস্করণে ছাপানো হয়েছিল এবং গরুর গাড়ি ও রেলগাড়িতে করে বয়ে নিয়ে ঘরে-ঘরে বিক্রি করা হয়েছিল। এ-সব পুস্তিকা চার বছরে ১,২০,০০,০০০ কপি বিক্রি ও বিতরণ করা হয়।
বয়সকালে টলস্টয় একজন সাধারণ কৃষকের মতোই সাদাসিধে কাপড় পড়তেন। নিজ হাতে নিজের জুতো তৈরি ও বিছানাপত্র সাজাতেন, ঘরদোর ঝাঁট দিতেন এবং একটা সাধারণ ও আবরণহীন টেবিলে কাঠের বাসন থেকে কাঠের চামচ দিয়ে খাবার তুলে খেতেন।
টলস্টয়ের বয়স যখন বিরাশি তখন ঘরের করুণ অশান্তি আর সহ্য করতে না পেরে এক বুক জ্বালা নিয়ে হতাশ মনে ১৯১০ সালের ২১শে অক্টোবর রাত্রিবেলায় স্ত্রীর কাছ থেকে অন্ধকার ও প্রচণ্ড শীতের মধ্যে পালিয়ে এলেন। তার এগারোদিন পরে এক রেল স্টেশনের একটি ছোট কামরায় তিনি নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন কৃষক পরিবেষ্টিত হয়ে। মৃত্যুকালে তিনি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর সব কিছুর ব্যবস্থা করবেন।‘ তাঁর শেষ বাক্য ছিল, ‘সবসময় কেবল খুঁজেছি।‘
শিক সেল : একটি বইয়ের জনপ্রিয় লেখক
পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ একজন মাত্র লেখকই আছেন যিনি একটা বই লিখে তার প্রতিটি শব্দের জন্য সাড়ে উনপঞ্চাশ ডলার করে পেয়েছেন। বইটা হল, ‘দ্য স্পেশালিস্ট’ তার লেখকের নাম হল শিক সেল। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে দ্য স্পেশালিস্টই প্রথম আর এই বইটার ওপর তার আস্থা এত কম ছিল যে বিকাশ তিনি এটা মাত্র দু’হাজার কপি ছাপান। কিন্তু এই কপিগুলো বিক্রি হতে মাত্র দু’সপ্তাহ লেগেছিল। বইটা সৌভাগ্যবশত হঠাৎ করে সবার মন কেড়ে নিয়েছিল। পাইন বনের মধ্যে আগুন লাগলে যেমন লাফাতে লাফাতে ছড়িয়ে পড়ে তেমনি করে এর প্রচার ও লেখকের সুখ্যাতি সারা দেশেময় ছড়িয়ে পড়ল। দ্যা গুড আর্থের চেয়েও এটার বেশি কপি বিক্রি হল। কিন্তু এটা লেখার জন্য শিক সেল গর্ববোধ তো করেনই নি বরং দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, এই জন্য যে অনেক পাঠক এর কৌতুক ও পরিহাসটা ভুল বুঝেছিলেন। তার উপস্থিতিতে কেউ বইটা নিয়ে আলোচনা করলে তিনি অত্যন্ত ব্ৰিত বোধ করেন। একবার তার মেয়ে তো কেঁদেই ফেলেছিল, কারণ সে মনে করেছিল যে বইটা পরিবারের সম্মানের হানি করেছিল।
তার লেখক হওয়ার বিষয়টি ছিল আকস্মিক। আসলে তিনি ছিলেন একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। তার অভিনেতা হওয়াটাও ছিল আকস্মিক ব্যাপার। তারো আগে তিনি ছিলেন করিগর, ইলিনয়ের আৰ্বোনতে রেলরাস্তার পাশের দোকানে তিনি কাজ করতেন। পরিবারের বড় বোনটির ছিল অভিনয় করার সখ, সে অভিনয় শেখার স্কুলে পড়াশোনা করত। সে বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি এল এবং এক গির্জায় অনুষ্ঠান প্রদর্শন করল। অনুষ্ঠান শেষ হলে শিক সেল বললেন, আরে, এটা তো আমি স্কুলে না গিয়েই শিখতে পারি। তার বোন তাকে বলল যে, যদি সে তা পারে তবে দেখাক না কেন। ব্যস, তিনি মঞ্চের মাঝখানে গিয়ে স্থানীয় টেলিগ্রাফ অপারেটরের অনুকরণ করে অভিনয় শুরু করে দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গ্রাম্য লোকগুলি তার অভিনয় দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল আসন থেকে। রঙ্গমঞ্চের ম্যানেজার তাকে নিয়োগ করে নিলেন, সাপ্তাহিক দশ ডলার হিসেবে পারিশ্রমিক নির্ধারণ করলেন। এতে শিকের সমস্ত জীবনটাই পালটে গেল। তারপর তিনি শিকাগোর দিকে ছুটলেন, মঞ্চে একটা চাকরি নিলেন এবং কীভাবে লোককে চমক লাগানো যায় তার মহড়া দিতে থাকলে তার বেতন ছিল অত্যন্ত কম, তাই তার কাছে প্রতিটি পেনিও ছিল মূল্যবান। অবশ্য তারপর নিজের অধ্যবসায় ও ঐক্যান্তিক আগ্রহ তাকে একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান এনে দিয়েছিল। তিনি হোটেলের জিনিস খেতেন না, তাই যেখানেই যেতেন সাথে করে একজন বাবুর্চি নিয়ে যেতেন। তার সাথে একট স্টিলের ট্রাঙ্কও থাকত, ট্রাঙ্কটাকে তিনি হাজার হাজার কৌতুকের পুস্তিকা রাখার আলমারিতে পরিণত করেছিলেন। তিনি ব্রডওয়ের ছয়টি সঙ্গীত নাটকে অভিনয় করেন। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হর্নপ্লেয়ার। কিন্তু নিজে হর্ন বাজাতে পারতেন না। তিনি প্যারিস সম্পর্কে লেখা নাট্য প্রদর্শনীতে অভিনয় করে পঞ্চাশ হাজার ডলার উপার্জন করেছিলেন; কিন্তু জীবনে কখনো প্যারিস দেখেন নি। ‘দ্য স্পেশালিস্ট’ বইটি রচনা করে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থোপার্জন করলেন আর তা দিয়ে আরেকটা বই লিখলেন, তার নাম ‘দ্য কর্ন হাস্কার ক্রেশিজ দ্য মোভিয়া’। নাট্যমঞ্চে হাজার দর্শকের সামনে দাঁড়াতে তিনি ভয় লজ্জাবোধ করতেন না; কিন্তু প্রেমিকার কাছে প্রথম বিয়ের প্রস্তাব করার সময় তিনি তোতলাতে শুরু করে দিলেন।
সমারসেট মম্ : একজন বিশ্বখ্যাত লেখকের নেপথ্য কথন
একসময়ে নিউইয়র্কের শীর্ষ নাট্যসমালোচকেরা সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ দশটি নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটে ভোট দিয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করল, তাতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে তিন শো বছরেরও আগে লেখা একটি পুরনো নাট্যলেখ্য ‘হ্যামলেট’ আর দ্বিতীয় হয়েছিল অপর একটি নাটক যার নাম–’রেইন’। হ্যাঁ, দক্ষিণ সাগরের উদ্দাম ও ভয়ঙ্কর ঝড়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা এ নাটক–যাতে আছে যৌনতা ও ধর্ম এবং সাগরের হিংস্র থাবার মতো ক্ষত-বিক্ষত করা প্রগাঢ় চেতনা! নাটকটি বিরচিত হয় বিখ্যাত সাহিত্যিক সমারসেট মমের একটা ছোটগল্পের ওপর ভিত্তি করে। ‘রেইন’ রচনার জন্য সমরসেট মম্ পেয়েছিলেন দু’লক্ষ ডলার; কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল নাটকটি লিখতে নাকি পাঁচ মিনিট সময় ব্যয় করা হয় নি। ব্যাপরটা ঘটেছিল এভাবে, মম্ ‘স্যাডি টমসন’ নামে একটা ছোটগল্প লিখেছিলেন। এটা নিয়ে তেমন আর মাথা ঘামান নি। একরাতে কোল্টন নামে তার এক বন্ধু বেড়াতে এলেন মমের বাসায়। শোবার সময় কোল্টন একটা কিছু পড়ে ঘুম আসার পূর্বপর্যন্ত সময় কাটাতে চাইলেন। মম্ তাকে ‘স্যাডি টমসনের’ পাণ্ডুলিপি পড়তে দিলেন। তাতে গল্পটা তার অসম্ভব রকমের ভালো লেগে গেল। তিনি রোমাঞ্চিত হয়ে ঘরময় পায়চারী শুরু করলেন, আর কল্পনায় গল্পটাকে নাটকরূপে দেখলেন যেটার ভাগ্যে ছিল অমরত্ব। সারারাত না ঘুমিয়ে পরদিন সকালে মমকে জানালেন যে গল্পটাকে একটা চমৎকার নাট্যরূপ দেয়া যেতে পারে।