লায়ানল ব্যারিমোর কিছুদিন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গিয়ে শিল্পকলা সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছেন। তার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ ছিল একজন শিল্পী হবার। একজন মঞ্চ ও চিত্রতারকা হবার আশা তিনি কখনো পোষণ করতেন না।
জীবনের কোনো কোনো সঙ্কটময় মুহূর্তে কপর্দকহীন এবং ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও থাকতে হয়েছিল তাকে। কখনো তার স্কেচগুলো পত্রিকাওয়ালাদের কাছে বিক্রি করতে পারতেন না। অবশ্য যে কোনো সময় বাড়ি থেকে টেলিগ্রাম করে টাকা আনাতে পারতেন; কিন্তু মাঝে-মাঝে টেলিগ্রাম করার মতো পয়সা-কড়ি থাকতো না তার হাতে। গ্রিনউইচ গ্রামের এক প্রান্তে অংশীদারী মালিকানায় একটা ছোটখাটো স্টুডিও ছিল তার। স্টুডিওর আসবাব সামগ্রী কিনে এটাকে উন্নত করার মতো অর্থ তখন তার ছিল না। থাকার মতো একটা বিছানাও ছিল না বলে মেঝের ওপর ঘুমুতে হত। আর যখন খুব শীত পড়ত, তখন বড় বড় বইপত্র দিয়ে শরীর ঢেকে রাখত। তাদের সাথে থাকত এক ছোঁকরা লেখক-তার একটা সোনার দাঁত ছিল। যখন হাত একেবারে খালি হয়ে যেত, তখন ঐ দাঁতটা দোকানে বন্ধক রেখে টাকা সংগ্রহ করত তারা।
মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে লায়ানল ব্যারিমোর একজন পাকাঁপোক্ত তারকা হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। এটা ব্রডওয়েবাসীদের জন্য এক গৌরবের বিষয় ছিল। তার ভাই জন যিনি পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ ব্যয়বহুল তারকা ও বোন এথেল তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্কের একটা রঙ্গমঞ্চকে তার নামে নামকরণ করেছিলেন।
তেপান্ন বছর বয়সে লায়ানল ব্যারিমোর তার তিরিশ বছরের লব্ধ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার সমন্বয় সাধন করে চিত্র পরিচালনায় আত্মনিযোগ করলেন। তিনি যথেষ্ট পড়াশোনা করতেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। ব্যারিমোরই ছিলেন প্রথম চিত্র পরিচালক যার ছায়াছবি তৈরির ব্যাপারে ব্যবহৃত শব্দগ্রহণকারী যন্ত্রটি সবদিকে ঘোরানো যায়। এটা এমন একটা আবিষ্কার যা সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণে বিপ্লবাত্মক অধ্যায়ের সৃষ্টি করল। তিনি লরেন্স ট্রিবেট ও বারবারা স্টানউইক-এর মতো অবিস্মরণীয় চিত্র পরিচালনা করে চিত্রশিল্প জগৎকে পূর্ণতা অর্জনে সহায়তা করেছিলেন।
বয়স যখন তেপান্ন তখন ব্যারিমোর বিশ্বাস করলেন যে, তার অভিনয় করার দিন ফুরিয়ে এসেছে। তখন তিনি মনস্থির করলেন যে, জীবনের বাকি দিনগুলো চিত্র পরিচালনা করেই কাটিয়ে দেবেন। ঠিক সে সময় আরেকটা সুযোগ এল তার অভিনয় ক্ষমতা প্রদর্শনের। নরমা বিয়ারার ‘এ ফ্রী সোল’ নামে একটা ছবি তৈরি করছিলেন। এতে বাবার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য একজন দক্ষ অভিনেতার অভিনয় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়ালেন লায়ানল ব্যারিয়োর আর তার স্বকীয় অভিনয় ক্ষমতার দ্বারা বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তুললেন চরিত্রটি। তার এই গৌরবময় অভিনয়ের জন্য তিনি একাডেমী অব মোশন পিকচার আর্টস এন্ড সায়েন্স’ নামক সম্মানিত পদক লাভ করলেন। এরপর একে একে সাফল্য এসে লুটিয়ে পড়তে লাগল তার পায়ের তলায়। তৈরি হলো তার অভিনয় সমৃদ্ধ ‘দ্য ইয়েলো টিকেট’, ‘মাতাহরি গ্রান্ড হোটেল’, ‘রাসপুটিন অ্যান্ড দ্য এমপ্রেস’ এবং ‘এ ওয়াইল্ডারনেস’ নামক বিখ্যাত ছবিগুলো।
লায়ানল ব্যারিমোর বলেছেন, সমস্ত জীবনটাই আমি একবার উঠেছি একবার নেমেছি। কেউ-কেউ বলেছেন, আমি ফুরিয়ে গেছি, আমার আর চিত্র জগৎকে দেবার মতো আর কিছু নেই–কিন্তু এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার মতো অবকাশ আমার কখনো হয় নি। আসলে আমি সবসময় এত বেশি ব্যস্ত থাকতাম যে, নিজের দুঃখকষ্ট নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার মতো সময় আমি কখনো পাই নি।
লিও টলস্টয় : জীবনবাদী লেখক
এবারে এক অবিশ্বাস্য জীবনকাহিনী শুনুন যা আরব্যউপন্যাসের মতো রোমহর্ষক। এটা হল এমন একজন প্রাতঃস্মরণীয় ও বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব যাকে এক পলক দেখার জন্য, যার গলার সুমিষ্ট স্বরটা একটিবার শোনার জন্য ও তার পোশাকের প্রান্তভাগ একবার ছুঁয়ে দেয়ার জন্য তাঁর অগণিত ভক্তরা তাঁর বাড়িতে অনবরত যাতায়াত করত–তিনি লিও টলস্টল।
তার জীবনকাহিনী যে-কোনো উপন্যাসের মতোই বর্ণাঢ্য। জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিয়াল্লিশ কামরাবিশিষ্ট ঐশ্বর্য পরিবেষ্টিত এক সুরম্য প্রাসাদে। আর লালিতপালিত হয়েছেন প্রাচীন রুশ আভিজাত্যের বিলাসিত পরিবেশে। যৌবনে তিনি ছিলেন একজন বিলাসী যুবক-সুন্দর ভঙ্গিমায় পদচালনা করতেন এবং কথা বলতেন, মস্কোর দর্জির দোকানে অনেক অর্থ খরচ করতেন। যৌবনে মদ খেতেন, মারামারি করতেন, অনেক জঘন্য পাপ কাজ এমনকি খুন-খারাপি করতেন। তাঁর নিজের কথায় একটা নোংরা পাপময় জীবন যাপন করতেন। কিন্তু যিশুর শিক্ষা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করে পরবর্তীতে সমস্ত রাশিয়ার খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। যৌবনে তিনি কলেজে অকৃতকার্য হন। এবং তার গৃহশিক্ষকরা তার মাথায় বিদ্যে ঢোকাবার আশা ত্যাগ করেন। কিন্তু তিনিই ত্রিশ বছর পর পৃথিবীর দুটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়ে গেলেন, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অমরগাথা হয়ে থাকবে। উপন্যাস দুটো হল–ওয়ার এন্ড পিস’, ও ‘এনা কারেনিনা। বন্ধুরা তাঁর বাড়িতে এসে একাধারে দীর্ঘদিন থেকে টলস্টয়ের সব কথা সাঁটলিপিতে লিখে নিত। তাঁর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা সুবিস্তারিতভাবে তারা বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীতে এসব বিবরণী বড় বড় পুস্তকাকারে ছাপা হয়েছে।