বায়রনের চেহারা ছিল একহারা গড়নের। তার চামড়া এত সাদা ছিল যে তার প্রতি আসক্ত রমণীরা প্রশংসা করে বলত যে, তিনি একটা সুন্দর কারুকাজ করা প্রদীপ্ত অ্যালবাস্টারের পাত্র। কিন্তু রমণীরা জানত না যে, তার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শরীরের মেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও অবিরাম ক্লান্তিকর যুদ্ধ। তিনি একহারা সুদর্শন থাকার জন্য সর্বদা অদ্ভুত খাবার খেতেন।
তার খাবার ছিল অত্যন্ত অল্প পরিমাণের–দিনে একবার মাত্র ভিনেগার ছিটানো আলু বা ভাত। মাঝেমধ্যে রুচি পরিবর্তনের জন্য শুকনো বিস্কুট চিবোতেন এবং একগ্লাস সোডা পান করতেন। শরীরের মেদ কমানোর জন্য তিনি তরবারি যুদ্ধ, মুষ্টিযুদ্ধ, ঘোড়ায় চড়া এবং সাঁতারকাটা অভ্যাস করতেন। তার অদ্ভুত রকমের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তার ক্ষিধে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছিল যার ফলে তার ঘরবাড়ি পেটেন্ট ওষুধের গন্ধে ভুরভুর করত। এতে করে একজন বিশ্ববিখ্যাত প্রেমিকের মননামুগ্ধকর প্রেমনিকুঞ্জটাকে একটা ওষুধ বিক্রেতার দোকান বলে প্রতীয়মান হত।
তিনি ঘুমের ঘোরে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখতেন, তাই বিছানার পাশে দুটো গুলিভরা পিস্তল রাখতেন। আর রাতের নিস্তব্ধতায় চিৎকার করতে করতে ও দাঁত কিড়মিড় করতে করতে জেগে উঠতেন এবং পিস্তল হাতে ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতেন। যে পুরানো বাড়িটাতে বায়রন রাত্রিকালে দুঃস্বপ্ন দেখতেন তাতে বহুদিন আগে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এক সন্ন্যাসীর প্রেতাত্মা আগমন করত, যিনি একসময় ওখানে বাস করতেন। লর্ড বায়রন শপথ করে বলেছিলেন যে, ওই প্রেতাত্মাটা কালো আলখাল্লা পরে এসে ঘরের জানালা দিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত আর তারপর গম্ভীর ও ধীর পদেক্ষেপে হেঁটে হেঁটে চলে যেত।
একবার লর্ড বায়রন ইতালিতে এসে শপথ করে বলেছিলেন যে, তিনি বিখ্যাত কবি শেলির প্রেতাত্মাকে একটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছেন। সে সময়ে শেলি ছিলেন সেখান থেকে অনেক মাইল দূরে; বায়রন তা জানতেন। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এর অল্পকালের মধ্যেই কবি শেলি মারা গেলেন এক পাহাড়িয়াহ্রদের মধ্যে ঝড়ের কবলে ডুবে। ব্যথিত বায়রন অবশ্য নিজের হাতে চিতা প্রস্তুত করে শেলির মরদেহটাকে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। একসময় একটা অন্ধ কুসংস্কার পেয়ে বসেছিল বায়রনকে। এক যাযাবর গণকার তার রাশি নির্ণয় করে ভবিষ্যদ্বাণী করে তাকে সাবধান করে দিল যে, তিনি সাঁইত্রিশ বছর বয়সে মারা যাবেন। তার ছত্রিশতম জন্মদিনের তিনমাস পরেই বায়রন সত্যি সত্যিই মারা যান। তিনি বিশ্বাস করতেন, এক নিদারুণ অভিশাপ তার সমস্ত পরিবারের উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। তাই তিনি বলেছিলেন ছত্রিশতম জন্মদিনটা হল তার বংশের লোকদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। কোনো কোনো চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক তার এই কথার সাথে একমত হতেও প্রস্তুত; কারণ বায়রনের বাবা ছত্রিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন আর বায়রনের মেয়ে, যার জীবনটা ছিল ঠিক তার বাবার মতোই–তিনিও তার ছত্রিশতম জন্মদিনের ঠিক আগেই মারা যান।
লায়ানল ব্যারিমোর : নিজের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ পান নি
১৯১৮ সালের এক রজনীতে লায়ানল ব্যারিমোর আমেরিকার ব্রডওয়েতে অনুষ্ঠিত ‘দ্য কপারহেড’ এর মিল্ট শ্যাঙ্কের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেন, সে রাত্রে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এটা ছিল একটা চমৎকার অনুষ্ঠান, একটা মহাবিজয় যা নাট্য জগতে এক অদৃশ্যপূর্ব ঘটনা ও ইতিহাসের অবতারণা করেছিল। অনুষ্ঠানের রোমাঞ্চিত দর্শকবর্গের অনুরোধে এক অভিনেতাকে প্রায় পনের বার পর্দার সামনে এসে মুখ দেখাতে হল, আর প্রতিবার দর্শকদের উত্তেজিত উল্লাসে ফেটে পড়ল থিয়েটার হলটি। যার তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ব্রডওয়ের থিয়েটার হলের সে অনুষ্ঠানটিকে পরিপূর্ণ সার্থকতা দান করেছিল তার নাম ‘লায়ানল ব্যারিমোর।
এ ঘটনার পনের বছর পর এই শক্তিমান অভিনেতার বড় হওয়ার অপরিসীম সাধনা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠালাভের ইতিহাস সম্পর্কে জানার অবকাশ হয়েছিল আমার। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ব্রডওয়ের অভিজাত বারিমোর পরিবারের এই সুদর্শন ব্যক্তিটিকে জীবনে আকাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য কোনো সংগ্রাম করতে হয় নি। আসলে আমার ধারণা ছিল ভুল। আমার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি স্বাভবসিদ্ধ গুরুগম্ভীর স্বরে বলেছেন, একটা মানুষকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ ও খ্যাতির স্বর্ণ-শিখরে উঠতে হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। তবে তা হল সাধনা আর একাগ্রতার ব্যাপার।
লায়ানল ব্যারিমোরের শৈশবকালটা বেশ অদ্ভূত ও এলোমেলো ধরনের ছিল! তার বাবা মরিস ম্যারিয়োর ছিলেন অসামরিক ও আকর্ষণীয় স্বভাবের ব্যক্তি যিনি তার বেপরোয়া আচরণের দরুন রঙ্গমঞ্চের অন্তরালে ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ছিলেন একজন অসামরিক এবং রুচিশীল মানুষ। অদ্ভুত সৌন্দর্যপিপাসু ছিলেন তিনি এবং সৌন্দর্যপিপাসার বহিপ্রকাশ ঘটানোর জন্য তিনি শেষ পেনিটিও ব্যয় করতে কুণ্ঠিত ছিলেন না। অন্য কোনো দেশ বা শহরে ভ্রমণে গেলে জাহাজে করে নানা ধরনের পশুপাখি যেমন ভালুক, বানর, বনবিড়াল, বিভিন্ন ধরনের পাখপাখালি ও নানা ধরনের কুকুর নিয়ে দেশে ফিরতেন। এক বছর স্টেটাস দ্বীপের এক শস্যখামারে গ্রীষ্মকাল কাটান তিনি এক বন্ধুর সাথে। সেখানে একজন নিগ্রো চাকর এবং বিভিন্ন জাতের ও আকারের পঁয়ত্রিশটি কুকুর ছাড়া আর আর কোনো সঙ্গী ছিল না। ব্যারিয়োর পরিবারের তিন বিখ্যাত অভিনেতা লায়ালন ব্যারিমোর, জ্যাক ব্যারিমোর এবং এথেল ব্যারিমোর ‘রাসপুটিন এবং সম্রাজ্ঞী’ ছবিতে একত্রে আত্মপ্রকাশ করেন যা হলিউডের জন্য একটা গর্বের বিষয় ছিল।