নিজের সৌন্দর্যবোধ এবং অদ্ভুত বিবেচনা শক্তি দ্বারা রমণীগণকে অনুভব করতে পারতেন যে তারা সুন্দরী। তার কোনো অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী রজনীতে তিনি তার নায়িকাদলের প্রতিটি মেয়েই তার কাছ থেকে এক বাক্স করে ফুলের তোড়া উপহার পেত। প্রত্যেক মহিলা, এমনকি বৃদ্ধারাও তার কাছে সহানুভুতিপূর্ণ ব্যবহার পেত। তিনি তার সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত তারকাঁদের সপ্তায় ৫০০০ ডলার বেতন দিতেন, মৌসুমের শেষে দেখা যেত তাদের কারো ব্যাংকে জিগফেল্ডের চেয়েও বেশি টাকা জমেছে। জিগফেল্ড পঁচিশ বছর বয়সে দুরন্ত কর্কশ শক্তিধর স্যান্ডোর ম্যানেজার হিসেবে ভাগ্যাদেবীর কৃপালাভ করেছিলেন! এর দু’বছর পরে একেবারে দেউলিয়া অবস্থায় দেখা গেল লন্ডনে তখন তার হাতে একটা শিলিংও ছিল না। মন্টিকার্লোতে গিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করতে বাজী ধরলেন তিনি–কিন্তু চাকা ঘুরতে ঘুরতে গায়ের জামাটা হারালেন। তবে কপর্দকহীন হওয়াটা এই মহান ব্যবস্থাপকের কাছে কোনো চিন্তার বিষয় ছিল না। তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল নিজের বুদ্ধি-বিবেক ও আচার-আচরণের জাদু দিয়ে দুঃখ-দৈন্য দূর করে সাফল্যের তুঙ্গে আরোহণ করতে পারতেন।
আমেরিকার চতুর প্রয়োজকরা এনা হেল্ডকে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রচুর অর্থ প্রদানের লোভ দেখাচ্ছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত মাত্র সাতাশ বছর বয়স্কপ্রায় অপরিচিত ও কপর্দকহীন জিগফেল্ডই একেবারে এনার পোশাক ঘরে উপস্থিত হলেন, তাঁকে মুগ্ধ করলেন এবং তাকে চুক্তিপত্রে সই করালেন আর তরতরিয়ে উঠে এলেন খ্যাতি ও মর্যাদার উচ্চশিখরে। এনা হেল্ড আমেরিকায় ঝড় তুললেন। তাঁর খ্যাতির ফলশ্রুতিতে তার নামে সুগন্ধিদ্রব্য, পাউডার, ককটেল, টুপি, ঘোড়া, কুকুর, সিগারেট ইত্যাদির নামকরণ করা হল। অবশেষে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার চরম শিখরে আরোহণ করে এনা পরিণয়বদ্ধ হলেন জিগফেল্ডের সঙ্গে।
জিগফেল্ড কোনো ব্যাপারে চিন্তা করে মনস্থির করতে অপছন্দ করতেন। তার টেবিলে সবসময় এক কৌটা জ্যৈষ্ঠমধু রাখতেন। এ সম্পর্কে এক বন্ধুর প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, ‘ওগুলো কালো, কাজেই কোন রঙটা আমার পছন্দ তা মনস্থির করতে আমাকে ভাবতে হয় না। চব্বিশ বছর ধরে কোলাহলময় নিউইয়র্কে ফ্লোরেঞ্জের প্রদর্শনীগুলো ছিল একেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার উদ্বোধনী রজনীতে রাস্তায় রাস্তায়
গাদাগাদি হয়ে যেত, পর্দার পেছনে স্টেজে গোলমাল হয়ে যেত, স্টেজ কর্মীদের মধ্যে একটা ছোটাছুটি শুরু হত, সবার মধ্যে একটা কাজ আর তাড়াহুড়োর প্রতিযোগিতা লেগে যেত–কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তিটি সবসময় শান্ত-সুবোধ, ধীরস্থির ও শান্ত সমাহিত।
রজনীর বিশিষ্ট দর্শকবৃন্দ শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জমকালো সান্ধ্যপোশাক এবং সাদা টাই পরে আসত কিন্তু জিগফেল্ড নিজে পরতেন একটা সাদাসিধে ধূসর রঙের ব্যবসায়ী পোশাক। ওই অনুষ্ঠানে নিজেকে তিনি একটা আসনে উপবেশন করার বিলাসটুকুন ভোগ করতে দিতেন না। ব্যালকনিতে ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পুরো অনুষ্ঠানটা পর্যবেক্ষণ করতেন।
১৯২৯ সালে ওয়াল স্ট্রিট ভেঙে পড়ার সময় এই মহান ব্যক্তিত্বটির কর্মজীবনে নাটক শেষের বিরতির আলো জ্বলে উঠে যবনিকাপাত হল। ১৯৩২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় জিগফেল্ড শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি যখন ভুল বকাবকি শুরু করেন, মনে হচ্ছিল তখন তিনি কল্পনায় একটা নাটক পরিচালনা করছিলেন। তাঁর মঞ্চ ছিল তখন হাসপাতলের এক শুভ্র কক্ষ, মঞ্চে তখন তার একজন চাকর ছাড়া দ্বিতীয় কেউ ছিল না। জিগফেল্ড বিছানায় উঠে বসে অদৃশ্য অভিনেতা অভিনেত্রীদেরকে ডিরেকসন দিচ্ছিলেন। তিনি চীৎকার করে বলছিলেন—’পর্দা উঠাও, দ্রুতলয়ে সঙ্গীত দাও, সমস্ত আলো জ্বেলে দাও। শেষ দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত হও।’
মৃত্যুর শেষমুহূর্তে তিনি বলছিলেন, ‘চমৎকার! দৃশ্যটা… সত্যি…চমৎকার… অপূর্ব।
বিলি সানডে : একজন জনপ্রিয় ধর্মপ্রচারক
ইতিহাসের সর্বাধিক জনপ্রিয় খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ছিলেন একজন মদ্যপান প্রতিযোগী ও প্রাক্তন খেলোয়াড়, তার নাম বিলি সানডে। আমি তাকে অনেকবার অনেক কাছে থেকে দেখেছি। তিনি ছিলেন এক প্রচণ্ড ঝড়ের মতো দুরন্ত, তাঁর ধর্মোপদেশ ছিল সার্কাসের মতো উপভোগ্য। তাঁর কথা শুনে কেউ কখনো ঘুমিয়ে পড়ে নি। তার একটা গর্বের বিষয় ছিল যে, একটানা পঁয়ত্রিশ বছর ধরে শয়তানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার কালে তিনি দশ লক্ষেরও বেশি মানুষকে কাঠগুঁড়োর পথ দিয়ে পরিচালিত করেছিলেন। সম্ভবত বিলি সানডেই ছিলেন মদ্য বিক্রয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী।
বিলি সানডে একবার সেন্টপিসবার্গে আট সপ্তাহ ধর্মপ্রচার করেছিলেন, খবরের কাগজের শিরোনামে তার ধর্মসভার খবর ছাপা হত। সমস্ত শহর তার ধর্মপ্রচারে ও উদাত্ত আহ্বানে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। দলে দলে লোক তার সভায় উপস্থিত হয়ে সুন্দর বাণীগুলো শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত।
বিলি সানডে বলতেন, আমি একটা নিকৃষ্ট গেঁয়ো ভূত, চুলে রাজহাঁসের চর্বি মেখেছি, উনুনের কালি দিয়ে জুতো রং করেছি। আমার বুড়ো নাকটা চটের তোয়ালে দিয়ে মুছেছি এবং আমার থালায় করে কপি পান করেছি। আমার যখন বলা উচিত ছিল এরকম করেছিলাম তখন এটা করে এবং যখন বলা উচিত ছিল ‘আমি দেখেছি তখন আমি আমি বলেছিলাম’ বলেছি। তবুও আমি স্বর্গে যাওয়ার আশা রাখি।