রক্ষীরা তাকে নিয়ে গেল সুড়ঙ্গের মুখে একটা গুহায়। লোহার গরাদ দেয়া দরজা ও জানালা দিয়ে প্রচুর আলো বাতাস সে ঘরে ঢুকছে। কব্জির বাঁধন খুলে দিলে রক্ষীরা তাকে সেই গুহার মধ্যে রেখে চলে গেল।
ওয়েনি কোল্ট জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল ওপার-এর সূর্য-মন্দির। যজ্ঞবেদির সিঁড়িতে অনেক রক্তের দাগ। প্রাঙ্গণে স্তূপীকৃত নর-কপাল। কোল্ট ভয়ে শিউরে উঠল। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল, কি শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
হঠাৎ তার মনে হল, প্রাঙ্গণের যজ্ঞ-বেদীর দিক থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ যেন কানে এল। ভাল করে কান পাততেই বুঝতে পারল, সত্যি কে যেন আসছে। নিঃশব্দে উঠে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। দূরাগত তারার আলোয় দেখল, প্রাঙ্গণ থেকে কে যেন তার গুহার দিকেই এগিয়ে আসছে; তবে সে মানুষ কি জন্তু তা সে ঠাহর করতে পারল না।
ওয়েনি কোল্ট তাকিয়েই আছে। মূর্তি তার গুহার দিকেই এগিয়ে আসছে। ও কি তার মৃত্যু দূত? তাকে যজ্ঞবেদীতে নিয়ে যেতে আসছে? কাছে আরও কাছে। সে এসে দাঁড়াল তার গুহার দরজার শিকের ওপারে। নরম গলায় ফিস্ ফিস্ করে কি যে বলল তার বিন্দু-বিসর্গও সে বুঝতে পারল না; শুধু বুঝতে পারল, যে এসেছে সে নারী।
কৌতূহলবশে সেও দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটা নরম হাত এসে তাকে স্পর্শ করল পরম আদরে। প্রাঙ্গণের মাথার উপরে খোলা আকাশ থেকে ভরা চাঁদের উজ্জ্বল জ্যোৎস্না এসে পড়েছে গুহার মুখে। শিকের ফাঁক দিয়ে মেয়েটি তাকে খাবার দিল। আর সেই সময় তার হাতটা টেনে নিয়ে তাতে ঠোঁট দুটো ছোঁয়াল।
ওয়েনি কোল্ট হতবাক। সে জানত যে এই তরুণী সন্ন্যাসিনীটি প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়েছে। ওপার-এর কিম্ভুতদর্শনে লোমশ পুরুষদের দেখে অভ্যস্ত তার চোখে ও মনে এই নবাগত পুরুষটি দেখা দিয়েছে দেবতার মহিমায়। তারপরই হঠাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দ পায়ে মন্দিরের খিলানের অন্ধকার পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মেয়েটির আনা খাবার খেয়ে কোল্ট শুয়ে শুয়ে কেবলই ভাবতে লাগল, কী এক দুর্নিরীক্ষ শক্তি মানুষের সব কর্মধারাকে পরিচালিত করে। ভাবতে ভাবতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
কোল্ট ঘুমের মধ্যেই একবার নড়ে উঠে চমকে জেগে উঠল। অস্তগামী চাঁদের আলোয় দেখল, দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাঞ্ছিতা নারী। চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে সে ভিতরে ঢুকল। কোল্ট লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। নাও হাত ধরে তাকে নিয়ে গেল ঘরের বাইরে।
অনেক অন্ধকার গলি-পথে ঘুরে ঘুরে ভিতরের প্রাচীরের কাছে এসে নাও আঙ্গুল বাড়িয়ে বলল, ঐ পথে চলে যাও। নাও-র হৃদয়কে নিয়ে যাও তোমার সঙ্গে। তোমাকে আর কোন দিন চোখে দেখতে পাবে না, তবু সারা জীবন এই মুহূর্তটির স্মৃতি আমি বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াব।
নাও তার খাপ-শুদ্ধ ছুরিটা কোল্টের হাতে তুলে দিল। এই বিপদসংকুল পথে নিরস্ত্র যাত্রা সমীচিন নয়। ভিতরের প্রাচীরের কাছে পৌঁছে কোল্ট একবার পিছন ফিরে তাকাল। চাঁদের আবছা আলোয় প্রাচীন
ধ্বংসস্তূপের ছায়ায় ছোট্ট সন্ন্যাসিনী খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোল্ট হাত নাড়িয়ে নীরবে শেষ বিদায় সম্ভাষণ জানাল।
ইতালীয় সোমালিল্যান্ড অভিযানের চূড়ান্ত সাফল্যের ব্যাপারে যে আত্মবিশ্বাস পিটার জাভেরি একেবারেই হারিয়ে ফেলেছিল, ধীরে ধীরে সে আবার সেটা ফিরে পাচ্ছে। বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সরবরাহ আসতে আরম্ভ করেছে; বিদ্রোহী নিগ্রোরাও অনেকটা শান্ত হয়েছে, আর। তার ফলে নতুন নতুন সংগ্রামী মানুষ এসে তার দলে যোগ দিচ্ছে। জাভেরির পরিকল্পনাটা এই রকমঃ দ্রুত ও আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে কিছু আদিবাসী গ্রাম ধ্বংস করে ও দু’একটা ফাঁড়ি দখল করে তড়িৎ গতিতে সীমান্ত পার হয়ে চলে আসবে, ফরাসী ইউনিফর্মগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য বাক্সবন্দী করে রাখবে এবং আবিসিনিয়াতে রাস্তাকারিকে গদীচ্যুত করবে; সেখানকার দলীয় প্রতিনিধিরা আগেই জানিয়েছে যে সেখানে বিপ্লবের ভূমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রতিনিধিরা আরও আশ্বাস দিয়েছে, একবার আবিসিনিয়া দখল করে সেখানে ঘাঁটি বানাতে পারলে সমগ্র উত্তর আফ্রিকার আদিম জাতিরা দলে দলে এসে তার পতাকাতলে সমবেত হবে।
ওদিকে মার্কিন পুঁজিপতিদের লোভের সুযোগ নিয়ে সুদূর বোখারোতে বহুবার, স্কাউট ও যোদ্ধা বিমানসহ দু-শ’ বিমানের একটা বহরকে হঠাৎ পারস্য ও আরবের আকাশপথে নিয়ে আসা হবে তার আবিসিনিয়ার ঘাঁটিতে। স্থানীয় লোকদের নিয়ে যে বিরাট বাহিনী সে গড়ে তুলেছে তার সঙ্গে এই সব শক্তি মিলিত হলে গোটা পরিস্থিতি আসবে তার অনুকূলে; তার সঙ্গে যোগ দেবে মিশরের বিদ্রোহী সেনাদল। এইভাবে, ইউরোপ একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে কোন সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। তার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সফল হবে, আর সে হবে চিরদিনের মত অজেয়।
হয়তো এটা একটা উন্মাদ স্বপ্ন; হয়তো পিটার জাভেরি সত্যি উন্মাদ- কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন্ বিশ্ব বিজয়ী কিছুটা উন্মাদ ছিল না?
সে যেন দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে তার সাম্রাজ্যের সীমান্ত একটু একটু করে দক্ষিণে প্রসারিত হচ্ছে। তারপর একদিন সে শাসন করবে একটা বিরাট মহাদেশ-সে হবে আফ্রিকার সম্রাট প্রথম পিটার।