জোরা খুব ভাল শিকার নিয়েই ফিরে এল। তার পিছনেই রাইফেল দুটো নিয়ে আসছে ওয়ামালা। কুলিরা চলেছে শিকারের ভারী বোঝা নিয়ে। কিন্তু শিবিরে পৌঁছবার আগেই পথের দু’পাশের ঝোপের ভিতর থেকে আরবরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’জন ওয়ামালার হাত থেকে রাইফেল দুটো ছিনিয়ে নিল। বাকিরা চেপে ধরল জোরাকে। রিভলবারটা টেনে বের করেও সে এই আকস্মিক আক্রমণকে ঠেকাতে পারল না। অচিরেই তার দুই হাত পিটমোড়া করে বেঁধে ফেলা হল।
সে জোর গলায় বলল, এ সবের অর্থ কি? শেখ আবু বতন কোথায়?
লোকগুলো হো-হো করে হেসে উঠল।
আর একটু এগিয়ে শিবিরের অবস্থা দেখে সে তো স্তম্ভিত। সব তাঁবু খুলে ফেলা হয়েছে। আরবরা রাইফেল হাতে যাত্রার জন্য প্রস্তুত। তার ক্ষণপূর্বের অতিথিটিকেও হাত বেঁধে আটকে রেখেছে।
এসব কেন করেছ আবু বতন? জোরা প্রশ্ন করল।
শেখ বলল, আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের দেশকে আমরা নাসরানিদের হাতে তুলে দেব না। আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি।
এই নারী ও আমাকে নিয়ে কি করতে চাও?
কিছুটা পথ তোমাদের সঙ্গে করেই নিয়ে যাব। সেখানে একটি ধনী লোক বাস করে। সে তোমাদের দু’জনকেই ভাল বাড়িঘর দেবে।
তার মানে কোন কালা সুলতানের কাছে আমাদের বেচে দেবে?
শেখ কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কথাটা সেভাবে আমি বলছি না। বরং বলতে চাই, আমরা চলে গেলে তোমরা যাতে এই জঙ্গলে শুকিয়ে না মর তাই একজন ভাল বন্ধুর কাছে তোমাদের উপহার-স্বরূপ রেখে যেতে চাই।
তীব্র ঘৃণায় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জোরা বলল, আবু বতন, তুমি ভণ্ড, বিশ্বাসঘাতক।
আবু বতন বলল, খুব হয়েছে। এস হে বাছারা, আমরা যাত্রা শুরু করি।
শিবিরে স্তূপীকৃত বাড়তি জিনিসপত্রে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আরবরা দল বেঁধে চলে গেল পশ্চিমের দিকে।
সময় কাটাবার জন্য দুর্ভাগ্যের সঙ্গিনীটিকে জোরা একটু একটু করে ইংরেজি শেখাতে শুরু করল। প্রথমে ইশারায় নানা জিনিস দেখিয়ে তার নাম বলে বলে শুরু করল। এইভাবে কয়েকদিনের মধ্যেই তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার মত একটা চলনসই ব্যবস্থা করে ফেলল।
প্রথম দিনের পর থেকেই বন্দিনীদের হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আরব রক্ষীরা সব সময়ই তাদের চোখে-চোখে রাখে।
তারা চলতে লাগল আবিসিনিয়ার গালা অঞ্চলের ভিতর দিয়ে। কিন্তু গালা অঞ্চলের একেবারে প্রান্তে পৌঁছে বন্যায় স্ফীত একটা নদীর তীরে তারা বাধা পেল। উত্তরে মূল আবিসিনিয়ায়ও যেতে পারল না, আবার দক্ষিণে যাবারও সাহস হল না। কাজেই তারা নদীর তীরেই অপেক্ষা করতে বাধ্য হল।
পিটার জাভেরি এসে দাঁড়াল ওপার-এর প্রাচীরের সামনে। দলের আগে আগে চলেছে মিগুয়েল রোমেরা; তার ঠিক পিছনে ওয়েনি কোল্ট আর বাকি সাদা মানুষরা রয়েছে সকলের পিছনে যাতে দরকার হলে তারা অবাধ্য কালা আদমিদের জোর করে এগিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে।
রোমেরো ও কোল্ট ভিতরের প্রাচীরের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাকি চারজন বাইরের প্রাচীরের ভিতর ঢুকতেই বিধ্বস্ত নগরের বিষণ্ণ নিস্তব্ধতাকে ভেঙে শোনা গেল আর্ত কণ্ঠস্বর।
উঠোনটা পার হয়ে ভিতরের প্রাচীরের দিকে এগোতেই দেয়ালের বিপরীত দিক থেকে তাদের কানে এল একটা নারকীয় হল্লা-বহুকণ্ঠের বীভৎস রণ-হুংকার আর দ্রুত পায়ের শব্দ। একটা গুলির শব্দ হল; তারপর আর একটা, আরও একটা।
রাইফেল উদ্যত করে তারা মন্দিরের দিকে পা বাড়াল। কিছুটা এগোতেই ছায়া-ঢাকা খিলান ও অসংখ্য দরজার পথে ছুটে বেরিয়ে এল একদল মানুষ। তাদের বীভৎস রণ-হুংকারে প্রাচীন নগরীর স্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল।
শুরু হল লড়াই। দু’জনই গুলি ছুঁড়তে লাগল। প্রতিপক্ষের কয়েকজন আহত হল। একটা ছুটন্ত গুলি এসে কোল্টের মাথায় লাগল। ধপাস করে সে মাটিতে পড়ে গেল, আর মুহূর্তের মধ্যে ওপার-এর বেঁটে মানুষগুলো তার দেহটাকে ঘিরে ফেলল।
মিগুয়েল রোমেরো বুঝল তার সঙ্গীর অবস্থা শোচনীয়। তার পক্ষে একাকি সঙ্গীকে উদ্ধার করার আশা সুদূরপরাহত। তাই সে চেষ্টা না করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সে পিছু হটতে লাগল। দুটো প্রাচীর পার হয়ে আবার সে ভোলা মাঠে ফিরে এল।
প্রাচীরের ভিতর থেকে আবার শোনা গেল অসভ্যদের বিজয়-উল্লাস। জাভেরি বলল, আমিও একা ওপার দখল করতে পারব না। অতএব সকলকেই শিবিরে ফিরে যেতে হবে।
বেঁটে সন্ন্যাসীরা কোল্টকে ঘিরে ধরে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। তারপর কাঁধে তুলে মন্দিরের ভিতরে নিয়ে গেল।
চেতনা ফিরে এলে কোল্ট দেখল সে একটা মস্ত বড় ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। এটাই ওপার মন্দিরের দরবার-কক্ষ। কোল্টের চেতনা ফিরে আসতে দেখে রক্ষীরা, এক ঝটকায় তাকে দাঁড় করিয়ে ওআ-র সিংহাসনের বেদীর দিকে ঠেলে দিল।
সম্মুখে সুদৃশ্য সিংহাসনে বসে আছে অপরূপ সুন্দরী এক তরুণী। তাকে ঘিরে রয়েছে প্রাচীন সভ্যতার জৌলুষের প্রাচুর্য। কিন্তু চেহারার লোমশ পুরুষ ও সুন্দরী সখিদল পরিবৃত হয়ে উদ্ধত ভঙ্গীতে সে বসে আছে। চোখ দুটি নির্মম ও নিষ্ঠুর।
তরুণী সিংহাসনে উঠে দাঁড়াল। বন্দীর উপর স্থির দৃষ্টি রেখে কোমর থেকে ছুরি বের করে মাথার উপর তুলে হিংস্র দ্রুতকণ্ঠে কি যেন বলে গেল।
ওআ-র কথা শেষ হতেই রক্ষীরা কোল্টকে বাইরে নিয়ে গেল। বেচারা বুঝতেও পারল না। যে অগ্নি দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনী তাকে দিয়েছে মৃত্যুদণ্ড।