ততক্ষণে কয়েকজন আরবও তাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ছুট গেল। তা দেখে জোরাও দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল যাতে আরবরা তাকে ধরবার আগেই সে পৌঁছে যেতে পারে। তার মুখের হাসি দেখেই ওপার-এর লা তার মনের ভাব বুঝতে পারল।
জোরা শুধাল, তুমি কে? একা এই জঙ্গলে কি করছ?
লা মাথা নেড়ে যে ভাষায় জবাব দিল তার মাথামুণ্ডু কিছুই জোরা বুঝতে পারল না। জোরা ড্রিনভ অনেক ভাষা জানে, কিন্তু কোন ভাষাতেই কাজ হল না। আরবরা তাদের ভাষায় কথা বলল; ওয়ামালা তার ভাষায় কথা বলল। কিন্তু কোন ফল হল না। তখন জোরা তার গলা জড়িয়ে ধরে তাঁবুর মধ্যে নিয়ে গেল। লা ইশারায় জানাল সে স্নান করবে।
আহারাদি শেষ হলে ওয়ামালা জোরার তাঁবুতে লা-র জন্য আর একটা খাটিয়া পেতে দিল।
জোরা বলল, ওয়ামালা, আজ রাতে তুমি তাঁবুর বাইরেই শোবে। এই নাও একটা পিস্তল।
শেখ আবু বতন অনেক রাত পর্যন্ত তার তাঁবুতে বসে সর্দারদের সঙ্গে কথাবার্তার শেষে বলল, এই নতুন চিজুটির জন্য যে দাম পাওয়া যাবে তেমনটি আগে কখনো মেলেনি।
ঘুম ভাঙতেই টারজান আকাশের তারার দিকে তাকাল। অর্ধেক রাত পার হয়ে গেছে। উঠে। শরীরটাকে টান টান করে নিচে নেমে সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
শিবিরের সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একটিমাত্র আঙ্কারি প্রহরী ধূনির পাশে বসে আছে। তার চোখের দৃষ্টিকে এড়িয়ে টারজান কুলিদের ঝুপড়ির পিছন দিয়ে ইউরোপীয়দের তাবুর কাছে পৌঁছে গেল। একটার পর একটা তাঁবুর পিছন দিকের দেয়াল কেটে ভিতরে ঢুকে সে লা-কে খুঁজতে লাগল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। লা-কে দেখতে পেল না।
অগত্যা টারজান আবার সেই গাছেই ফিরে গেল, রাতটা সেখানে কাটিয়ে সকাল হলে আবার বেরিয়ে পড়ল লা-র সন্ধানে।
এক সঙ্গে তৈরি হয়ে এসে দু’জন প্রাতরাশ খেতে বসল তাঁবুর বাইরে গাছের ছায়ায়। ওয়ামালা পরিবেশন করল। জোরার মনে হল, শেখদের ঘরগুলোতে যেন একটা কর্মব্যস্ততা চলেছে। ব্যাপারটাকে সে কোনরকম গুরুত্ব দিল না, কারণ মাঝে মাঝেই ওরা তাঁবুগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে যায়।
প্রাতরাশের পরে জোরা তার রাইফেলটা তেল দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দুটো কালো কুলিকে সঙ্গে নিয়ে শিকারে বেরিয়ে গেল। লা তাদের চলে যেতে দেখল, কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও জোরা তাকে ডাকল না বলে সে তাদের সঙ্গে গেল না।
আবু বতনের একই জাতির আর এক শেখের ছেলে ইব্ন দামু এই অভিযানে ইবন্ বতনের ডান হাত। দূর থেকে অনেকক্ষণ ধরেই সে মেয়ে দুটির উপর নজর রেখেছিল। একজন বন্দুকবহনকারী ও দু’জন কুলিকে নিয়ে জোরাকে বেরিয়ে যেতে দেখেই সে বুঝল যে ওরা শিকারে চলে গেছে।
সঙ্গী দুটিকে নিয়ে সে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর ওপার-এর লা-র তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল। তার সামনে পৌঁছে ইবন্ দামুক কি যেন বলল। উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথাটা নেড়ে লা তাঁবুর, দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ইবন্ দামুক আর একটু কাছে গিয়ে লা-র খোলা কাঁধে হাত রাখল।
লা-র দুই চোখে আগুন জ্বলে উঠল। লাফ দিয়ে সরে গিয়ে কোমরের ছুরির বাটটা চেপে ধরল। ইবন্ দামুক কয়েক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু তার এক সঙ্গী লাফিয়ে পড়ে তাকে ধরতে গেল।
লোকটা মহামূর্খ! লা বাঘিণীর মত তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বন্ধুরা বাধা দেবার আগেই লার ছুরিটা পর পর তিনবার আমূল বিদ্ধ হল তার বুকে। মরণ-আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে তার মৃতদেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
সে আর্তনাদ শুনে অন্য আরবরাও ছুটে এল। লা চীৎকার করে বলল, দূরে থাক। অগ্নি-দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনীর গায়ে কেউ হাত তুলতে চেষ্টা করে না।
তার কথাগুলো কেউ বুঝল না। কিন্তু বুঝল তার জ্বলন্ত চোখ ও রক্তাক্ত ছুরির অর্থ। সকলেই দূরে দাঁড়িয়ে হৈ-চৈ করতে লাগল। এ সবের অর্থ কি ইবন্ দামুক? আবু বতন প্রশ্ন করল।
লোকটা ওকে স্পর্শও করেনি, অথচ
আবু বতন বলল, সিংহিণী হলেও ওর কোন ক্ষতি করা চলবে না।
ইবন্ দামুক বলল, উল্লাহ! কিন্তু ওকে পোষ মানাতে তো হবে।
শেখ বলল, যে লোক ওর জন্য সবচাইতে বেশি স্বর্ণমুদ্র দেবে সে কাজের ভারটা সেই নেবে। আমাদের একমাত্র কাজ ওকে খাঁচায় বন্দী করা। শোন বাছারা, ওকে ঘিরে ধরে ছুরিটা কেড়ে নাও। ভাল করে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে ফেল। অন্য সকলে ফিরে আসার আগেই আমরা তাঁবু তুলে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকব।
ডজনখানেক লোক একযোগে লা-র উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সিংহিণীর মত সেও লড়তে লাগল। ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত হল অনেকে। আরও একটি আরবের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তবু শেষ পর্যন্ত লাকে পরাজয় স্বীকার করতে হল। ছুরিটা কেড়ে নিয়ে তার দুই হাত শক্ত করে বেঁধে ফেলা হল।
দু’জন সৈনিককে পাহারায় রেখে আবু বতন অন্য চাকরদের সঙ্গে নিয়ে যাত্রার আয়োজন করতে লাগল। ইবন্ দামুকের উপর জিনিসপত্র ও খাবার-দাবার গুছিয়ে নেবার ভার দিয়ে সে নিজে গেল ইউরোপীয়দের তাঁবু লুট করতে। আর বিশেষ নজর জোরা ড্রিনভ ও জাভেরির তাঁবুর উপর। আশানুরূপ সোনাদানা না পেলেও জোরার তাঁবুতে একটা বাক্সের মধ্যে সে প্রচুর টাকা পেল। দূরদর্শী জাভেরি তার। অর্থ-ভাণ্ডারের বেশি অংশটাই তাঁবুর মেঝেতে মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। তাই সেটার খোঁজ আবু বতন পেলই না।