কাহিনী শেষ করে লা বলল, তুমি এসে পড়েছ, এবার আমাদের পালাতে হবে।
টারজান অসহায়ভাবে বলল, কোন পথে পালাব?
লা বলল, আমার ঘরের পিছনের দেয়ালে দীর্ঘকাল ধরে অব্যবহৃত একটা সুড়ঙ্গ আছে।
সেটাই আমাদের পালাবার একমাত্র পথ।
হাতে হাত ধরে দু’জন অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে পা বাড়াল।
অনেক কষ্টের পথ পার হয়ে এক সময় দু’জনই একটা নির্জন ঘরে এসে বিশ্রাম নিল। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। প্রধান সন্ন্যাসিনীর দুটি সুন্দর চোখ অরণ্য-দেবতার সুন্দর শরীরের উপর নিবদ্ধ।
এক সময় লা ডাকল, টারজান!
চোখ তুলে টারজান বলল, বল লা।
আমি আজও তোমাকে ভালবাসি টারজান।
ও কথা এখন থাক।
না, আমাকে বলতে দাও। এ কথা বলতে আমার দুঃখই হয়, তবু এ যে এক মধুর দুঃখ-আমার জীবনের একমাত্র মধুস্বাদ।
তার কাঁধে হাত রেখে টারজান বলল, তুমি চিরদিনই আমার অন্তর অধিকার করে আছ লা। তাকে ভালবাসাও বলতে পার।
টারজান কোন জবাব দিল না। দু’জন চুপচাপ এখন শুধু রাত নামার অপেক্ষা, যাতে সকলের অলক্ষ্যে তারা শহরে নামতে পারে। টারজনের মনে একটিমাত্র চিন্তা-কেমন করে তাকে আবার সিংহাসনে বসানো যায়।
লা বলল, অগ্নি-দেবতা যখন রাতের বিশ্রাম নিতে যায় তার ঠিক আগে সব সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা দরবার-কক্ষে সমবেত হয়। আজ রাতেই সেই সমাবেশ হবে। তখন আমরা শহরে নামতে পারব।
তারপর? টারজনের সাগ্রহ প্রশ্ন।
দরবার-কক্ষে যদি আমরা ওআকে খুন করতে পারি, সেই সঙ্গে ডুথকেও, তাহলে আর ওদের কোন নেতা থাকবে না। আর নেতাহীন হলেই ওরা শক্তিহীন।
বেলা পড়ে এল। সূর্য নেমে এল পশ্চিম আকাশে। ক্রমে সন্ধ্যা হল। সকলের অলক্ষ্যে প্রাঙ্গণ পেরিয়ে দু’জন পথে নামল। সন্ন্যাসীরা টের পেয়ে হৈ-হৈ করে তাদের পিছু নিল। টারজান এবার লাকে কাঁধে ফেলে দ্রুত ছুটতে লাগল।
বাইরের জগতের অন্ধকারে ওপার-এর মানুষরা অভ্যস্ত নয়। তাই আর না এগিয়ে তারা ফিরে গেল।
টারজান লা-কে মাটিতে নামিয়ে দিল। লা কিন্তু তবু তার গলা জড়িয়ে ধরেই রইল। তার বুকের মধ্যে মুখ রেখে কেঁদে উঠল।
টারজান বলল, কেঁদো না লা। আমরা আবার ওপার-এ ফিরে যাব; তোমাকে আবার সিংহাসনে বসাব।
লা বলল, আমি সেজন্য কাঁদছি না।
তাহলে?
কাঁদছি আনন্দে, কারণ এখন আমি অনেকটা সময় তোমার সঙ্গে একলা থাকতে পারব।
একটা গাছে চড়ে তারা রাতটা কাটাল।
ভোরে প্রথম ঘুম ভাঙ্গল টারজনের। আকাশ মেঘে ঢাকা। ঝড় উঠবে। অনেক সময় হয়ে গেল কোনরকম খাবার মুখে পড়েনি। আগের দিন সকাল থেকে লাও কিছু খায়নি। অতএব সকলের আগে চাই কিছু খাবার। আর এখানে খাবার মানেই শিকার। টারজান একবার ঘুমন্ত লা-র দিকে তাকিয়ে শিকারের সন্ধানে চলে গেল।
একটা শুয়োরের রাং কেটে নিয়ে টারজান ফিরে চলল সেই গাছটার দিকে যার উপরে সে ঘুমন্ত লা কে রেখে এসেছে। সেখানে পৌঁছে দেখল লা নেই। নাম ধরে ডাকল, সাড়া পেল না। কোথায় গেল লা? নিশ্চয় ওপার-এর দিকে ফিরে গেছে। সেটাই তো তার একমাত্র পরিচিত জায়গা। টারজান ভাবল, তার ফিরতে যত দেরিই হয়ে থাকুক, লা কোনমতেই তার আগে ওপার-এর পর্বত-প্রাচীরে পৌঁছতে পারবে না। পথেই সে তাকে ধরে ফেলতে পারবে। টারজান তাই ওপার-এর পথেই পা চালিয়ে দিল।
কিন্তু পর্বত প্রাচীরের সানুদেশে পৌঁছেও তাকে দেখতে না পেয়ে সে একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠল। সেখান থেকে অনেক দূরে ওপার-কে দেখা যায়। এখানে বৃষ্টি খুবই অল্পই হয়েছে। ফলে লা ও তার নেমে যাওয়ার পায়ের ছাপ বেশ স্পষ্টই চোখে পড়ছে। কিন্তু সে পথ বেয়ে উপরে ওঠার কোন পায়ের ছাপই তো দেখা যাচ্ছে না। তাহলে লা গেল কোথায়? তবে কি সে জঙ্গলের পথ ধরেই অন্য দিকে চলে গেছে?
দ্রুত পায়ে পাহাড় থেকে নেমে সে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।
বনপথ ধরে কিছুদূর এগিয়েই নদীর তীরে সে একটা শিবির দেখতে পেল। তার মনে আশা জাগল, এখানে হয়তো লার দেখা মিলবে। কাঁটা গাছের বেড়া দেয়া জায়গাটার মাঝখানে কিছু সাদা মানুষদের তাঁবু; গাছের ছায়ায় বসে কুলিরা ঝিমুচ্ছে; একটা মাত্র আস্কারি রয়েছে পাহারায়; বাকিরা রাইফেল পাশে রেখে দিবান্দ্রিা দিচ্ছে। কিন্তু ওপার-এর লা-কে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। তবে কি লা-কে কোথাও বন্দী করে রেখেছে? কিন্তু রাতের অন্ধকারে ছাড়া তো আর সন্ধান করা যাবে না। অতএব তাকে অপেক্ষা করতেই হবে। কাছেই একটা গাছের উপরে উঠে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
সন্ধ্যাবেলা জোরার জন্য রান্না করতে করতে বাচ্চা চাকর ওয়ামালা বলল, এর আগে তোমাকে বাদামী বাওয়ানার কাছে রেখে গিয়েছিল; সে তোক ভাল ছিল না। শেখ আবু বতনকেও আমার বিশেষ ভাল মনে হচ্ছে না। এখন বাওয়ানা কোল্ট এসে পড়লে বাঁচি।
জোরা বলল, আমারও তাই মনে হয়। ওপার থেকে ফিরে আসার পর থেকেই আরবরা যেন কেমন হয়ে উঠেছে।
ওয়ামালা বলল, সারাদিন তারা সর্দারের তাঁবুতে বসে ফুসুর-ফুসুর করেছে, আর আবু বতন বারবার তোমার দিকে তাকিয়েছে।
জোরা বলল, ওটা তোমার কল্পনা ওয়ামালা। এত সাহস তার হবে না।
পরমুহূর্তেই সে হঠাৎ বলে উঠল, ওদিকে দেখ ওয়ামালা। ও কে?
কালো লোকটি সেই দিকে চোখ ফেরাল। শিবিরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। সুন্দরী যুবতীটি এক দৃষ্টিতে তাদের দিকেই তাকিয়েছিল।