তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল জট-বাঁধা চুল-দাড়িওয়ালা আর একটি লোক। তার হাতে-পায়ে সোনার তাগা বাঁধা, গলায় সাতনরী হার। নিচে মেঝের উপর অনেক নর-নারীর জটলা-তারা ওপার-এর অগ্নি দেবতার সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী।
লোকগুলো টারজানকে এনে সিংহাসনের নিচে ফেলে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে চৈতন্য ফিরে আসায় টারজান চোখ মেলে চারদিকে তাকাল।
সিংহাসনের পাশে দাঁড়ানো লোকটিকে বলল, এ সবের অর্থ কি ডুথ? লা কোথায়? তোমাদের প্রধান সন্ন্যাসিনী কোথায়?
মেয়েটি ক্রুদ্ধ হয়ে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জেনে রাখ হে বিদেশী, আমিই প্রধান সন্ন্যাসিনী। আমার নাম ওআ, অগ্নি-দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনী আমি।
তাকে উপেক্ষা করে টারজান আবার ডুথকে জিজ্ঞাসা করল, লা কোথায়?
ওআ রাগে জ্বলে উঠল। তার হাতের বলিদানের খড়ের রত্নখচিত হাতলভাঙ্গা ছাদের ফাটল দিয়ে আসা সূর্যকিরণে ঝিকমিকিয়ে উঠল। লাফ দিয়ে বেদীর শেষ প্রান্তে এসে সে চীৎকার করে বলে উঠল, সে মারা গেছে। ঠিক যেমন তুমি মারা যাবে যখন তোমার রক্ত দিয়ে আমরা অগ্নি-দেবতার পূজা করব। লা ছিল দুর্বল। সে তোমাকে ভালবেসেছিল। অথচ দেবতা তোমাকে বেছে নিয়েছিল বলি হিসেবে। কিন্তু ওআ শক্তিময়ী। টারজান ও লা তার কাছ থেকে ওপার-এর সিংহাসন চুরি করে নিয়েছিল। এবার সে তর প্রতিশোধ নেবে। ওকে নিয়ে যাও। বলির যূপকাষ্ঠে ফেলার আগে ওকে যেন আমাকে আর না দেখতে হয়।
টারজনের পায়ের বেড়ি কেটে দিয়ে তাকে নিয়ে চলল ওপার-এর অন্ধকার কারাকক্ষের দিকে। মশালের আলোয় পথ দেখে দেখে তাকে কারাকক্ষে রেখে লোকজনরা চলে গেল।
আগেও একবার টারজান এই কারাগারে ছিল; আর পালিয়েও গিয়েছিল। কাজেই এবারও সে সঙ্গে সঙ্গে পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে দিল।
সে বুঝতে পারল, ঘরের একমাত্র ঘুলঘুলির ওপারের বারান্দাটাতে কোন সন্ন্যাসী পাহারায় নেই। পালাবার এই তো সুযোগ।
ঘুলঘুলিটার লোহার শিক বেঁকিয়ে টারজান লাফিয়ে পড়ল নিচের অন্ধকার বারান্দায়। ঘরের পর ঘর পার হয়ে সে এগিয়ে চলল।
টারজনের সামনে কাঠের হুড়কো দেয়া একটা বড় দরজা। দ্রুত হাতে হুড়কোটা তুলে দরজা খুলে সে ভিতরে পা দিল।
শিবিরে আসবার পরদিন ওয়েনি কোল্ট সাংকেতিক ভাষায় একটা লম্বা চিঠি লিখে ছোকরা চাকরটাকে দিয়ে সেটা উপকূলে পাঠিয়ে দিল। নিজের তাঁবু থেকেই জোরা ড্রিনভ সেটা দেখতে পেল। কিছুক্ষণ পরে কোল্ট এসে হাজির হল জোরার তাঁবুর পাশে বড় গাছটার ছায়ায়।
জোরা বলল, কমরেড কোল্ট, আজ সকালেই তুমি একটি চিঠি পাঠিয়েছ।
দ্রুত চোখ তুলে কোল্ট বলল, হ্যাঁ।
তোমার জানা উচিত ছিল যে এই অভিযানে একমাত্র কমরেড জাভেরি ছাড়া আর কেউ চিঠি লিখতে পারে না।
কোল্ট বলল, আমি জানতাম না। আমি উপকূলে পৌঁছবার আগেই কিছু টাকা সেখানে এসে থাকার কথা ছিল। টাকাটা আসেনি। সেটার খোঁজ নিতেই ছোকরাকে পাঠিয়েছি।
ও, বলে জোরা চুপ করল।
বিকেলে দু’জন একসঙ্গে শিকারে বের হল। একসঙ্গে রাতের খাবার খেল। এইভাবে দিন কাটতে লাগল। তারপর একদিন উত্তেজিত কালা আদমি এসে খবর দিল, অভিযাত্রীরা ফিরে এসেছে। সকলেই বুঝল, ছোট দলটির পতাকায় জয়ের বার্তা লেখা হয়নি। নেতাদের মুখে পরাজয়ের হতাশা। জাভেরি জোরাও কোল্টের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করল।
রাতে খাবার টেবিলে বসে দু’পক্ষই তাদের অভিজ্ঞতার কথা শোনাল। রঘুনাথ জাফরের মৃত্যু, করে দেয়া ও তার ভৌতিক পুনরভ্যুত্থানের কাহিনী সকলকেই রোমাঞ্চিত কলে তুলল।
পরদিন সকাল থেকেই ওপার-এ অভিযান পরিচালনা নিয়ে একটা বৈঠক বসল। আলোচনায় স্থির হল, পুরো দলটাই ওপার-এর প্রাচীর পর্যন্ত যাবে; কিন্তু যোদ্ধাদের মধ্যে মাত্র দশজন সাদা মানুষদের সঙ্গে শহরে ঢুকবে।
নতুন অভিযানের উদ্যোগ-আয়োজনেই কয়েকটা দিন কেটে গেল। একদিন সকালে জাভেরি ও তার দলবল নতুন করে ওপার-এর পথে যাত্ৰ করল। জোরা ড্রিনভও তাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু যেহেতু উত্তর আফ্রিকার অনেক এজেন্টের কাছ থেকে চিঠিপত্র আসার কথা আছে তাই তাকে শিবিরে রেখে যাওয়া হল। আবু বতনও তার সেনাদল ও কিছু চাকরবাকরসহ শিবির পাহারা দেয়ার জন্য রয়ে গেল।
ঘরের ভিতরে পা দিয়েই টারজান বুঝতে পারল, আবার সে বন্দী হয়েছে। এখন সে কি করবে? ভাবতে ভাবতেই ঘরের পিছন দিক থেকে চুপি চুপি পা ফেলার শব্দ তার কানে এল। খাপ থেকে ছুরি খুলে সে চকিতে ঘুরে দাঁড়াল। ও কার পায়ের শব্দ! নিঃশব্দে সে অপেক্ষা করতে লাগল।
কে তুমি? একটি নারী-কণ্ঠের প্রশ্ন।
তুমি কোথায়? টারজনের পাল্টা প্রশ্ন।
ঘরের পিছন দিকে, স্ত্রীলোকটি জবাব দিল।
তারপর বলল, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। এ কণ্ঠস্বর আমার পরিচিত। তুমি তো অরণ্যরাজ টারজান।
টারজান সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার বল তো? ওআ হয়েছে প্রধান সন্ন্যাসিনী, আর নিজের কারাগারে তুমি নিজেই বন্দী?
লা তার দুঃখের কাহিনী শোনাল। ওআ ডুথের সঙ্গে ভালবাসা করে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তোলে। টারজানকে ভালবাসার জন্য রাজ্যের জনসাধারণ এমনিতেই লার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। এবার ওআর মিথ্যা প্রচারের ফলে সকলেই তার বিরুদ্ধে গেল। লাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে সেখানে বসাল ওআকে, আর লাকে করল বন্দিনী।