জোরা এবার বলল, অবশ্য মোটামুটি পরিকল্পনাটা আমাদের কারো কাছেই গোপনীয় কিছু নয়। মূল পরিকল্পনাটা হচ্ছে, পুঁজিবাদী শক্তিগুলোকে এমনভাবে যুদ্ধ ও বিপ্লবের মুখে ঠেলে দিতে হবে যাতে তারা আমাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে না পারে। আমাদের প্রেরিত প্রতিনিধিরা দীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষের বিপ্লবকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে যাতে গ্রেট ব্রিটেনের মনোযোগ ও সামরিক শক্তি সেই দিকে আকৃষ্ট হতে বাধ্য হয়। কিন্তু ফিলিপিনে আমাদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। চীনের অবস্থা তো তুমি ভালই জান। আমরা আশা করি, আমাদের সহায়তায় অচিরেই তারা জাপানের পক্ষে বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। ইতালি একটি সাংঘাতিক শত্রু, আর প্রধানত সে দেশকে ফ্রান্সের সঙ্গে একটা যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতেই আমরা এখানে এসেছি।
কোল্ট তবু প্রশ্ন করল, কিন্তু আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে জাভেরি ইতালি ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ লাগাবে কেমন করে?
এই মুহূর্তে ফরাসী ও ইতালীয় কমরেডদের একটি প্রতিনিধিদল রোমে রয়েছে ঠিক এই কাজেরই জন্যে। ফরাসী সেনাবাহিনী কর্তৃক ইতালীয় সোমালিল্যান্ড অভিযানের পরিকল্পনা সমন্বিত কাগজপত্র তাদের সঙ্গে দেয়া হয়েছে।
যথাসময়ে কমরেড জাভেরির রোমস্থ জনৈক গুপ্ত সদস্য ফ্যাসিস্ট সরকারকে এই ষড়যন্ত্রের কথাটা। জানিয়ে দেবে; আর প্রায় সেই একই সময়ে আমাদের অভিযানের কিছু সাদা মানুষ ফরাসী সামরিক অফিসারের ইউনিফর্ম গায়ে চড়িয়ে আমাদেরই কালো মানুষদের ফরাসী স্থানীয় সৈনিক সাজিয়ে ইতালীয় সোমালিল্যান্ড আক্রমণ করবে।
কোল্ট সোসাহে বলে উঠল, পরিকল্পনাটি যেমন দুঃসাহসিক তেমনি বিরাট, কিন্তু এ রকম একটা পরিকল্পনাকে সফল করতে তো প্রচুর অর্থ ও জনবলের প্রয়োজন।
মেয়েটি বলল, আমি অবশ্য সব কথা জানি না, তবে এটুকু জানি যে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজের জন্য এই যথেষ্ট অর্থ সে ইতোমধ্যেই সগ্রহ করতে পেরেছে; আর বাকি অর্থের জন্য এই অঞ্চল থেকে পাওয়া সোনার উপরেই সে নির্ভর করছে।
মাথার উপরে গাছের ডালের উপর টান-টান হয়ে শুয়ে টারজান কান খাড়া করে সবকিছুই শুনছে।
কোল্ট আবার বলল, আচ্ছা, কথাটা যদি খুবই গোপনীয় না হয় তাহলে বলতো এত বেশি পরিমাণ। সোনা কমরেড জাভেরি কোথায় পাবে বলে আশা করছে।
ওপার-এর বিখ্যাত রত্ন-ভাণ্ডারে। আশা করি তার কথা তুমিও শুনেছ।
তা শুনেছি, কিন্তু তাকে নিছক উপকথা ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি। এ ধরনের রত্ন-ভাণ্ডারের কথা সারা বিশ্বের গ্রাম্য কাহিনীতে অনেক শোনা যায়।
কিন্তু ওপার উপকথা নয়।
মাথার উপরে টারজান নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে গেল। যাবার আগে নকিমাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিল।
কোল্ট ও জোরার কথাবার্তা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরতে লাগল। এক সময় টারজান আবার সেখানে ফিরে এল। এবার কিন্তু সে একা নয়।
জোরা বলল, জাফরকে কে যে মেরেছে তা হয়তো আমরা কোনদিনই জানতে পারব না।
তার কথা শেষ হবার আগেই তাদের মাথার উপরকার গাছের ডালে একটা সর-সর শব্দ হল, আর তারপরেই একটা ভারী দেহ ছিটকে পড়ল দু’জনের মাঝখানের টেবিলের উপরে। টেবিলটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেল।
দু’জনেই লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোল্ট চকিতে রিভলবারটা বের করল, আর জোরা পিছনে সরে গিয়ে উদগত চীৎকারটাকে চেপে দিল। কোল্টের মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। তাদের দুজনের মাঝখানে চিৎ হয়ে পড়ে আছে রঘুনাথ জাফরের মৃতদেহ; মৃত চোখ দুটি তাকিয়ে আছে রাতের অন্ধকারের দিকে।
টারজান ও নকিমা পাহাড়ের চূড়াকে অতিক্রম করে নির্জন উপত্যকার পথে এগিয়ে চলেছে তাদের সামনেই দেখা যাচ্ছে প্রাচীন ওপার-এর দীর্ঘ প্রাচীর, সুউচ্চ গৃহশীর্ষ ও গম্বুজের সারি। আফ্রিকার উজ্জ্বল সূর্যকিরণে শহরের লাল ও সোনালী গম্বুজ ও মিনারগুলো ঝকঝক করছে।
টারজান ইতঃপূর্বেও আর একবার ওপারে এসেছিল। সেবারে প্রধান পুরোহিত কাড়জিকে পরাস্ত করে সে লা-কে তার প্রিয় প্রজাদের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিল। সেবারে ওপার-এর মানুষদের বন্ধুত্বের স্মৃতি নিয়েই সে ফিরে গিয়েছিল। তারপর বেশ কিছু বছর ধরে লা-কে সে বান্ধবী বলেই জানে। সেখানে বন্ধুর সমাদর পাবার আশা নিয়েই সে ওপার-এর পথে চলেছে।
কাজেই নির্ভয়ে ও নিঃশংকচিত্তে সে ওপারের নিরেট পাথরের বহিঃপ্রাচীরের ফাটলের ভিতর দিয়ে ঢুকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। সেখানে খানিকটা ভোলা জায়গার ওপারে আরও একটা সংকীর্ণ পথ পার হয়ে সে একটা প্রশস্ত রাজপথে গিয়ে পড়ল। তার বিপরীত দিকেই দাঁড়িয়ে আছে ওপার এর বিরাট মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ।
নিঃশব্দে সে মন্দিরের দরজা পার হয়ে গেল। দুই পাশে সারি সারি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভের গায়ে নানা কিন্তু দর্শন পাখির মূর্তি খোদাই করা।
টারজান নির্ভয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে পা রাখল। সঙ্গে সঙ্গে একটা পাকানো গদা সজোরে তার মাথায় এসে পড়ল। টারজান অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
জটা-বাঁধা চুল-দাড়িওয়ালা জনবিশেক লোক তাকে ঘিরে ফেলল। ছোট ছোট বাঁকানো পায়ে তারা এগিয়ে এল। তাদের পাট-করা দাড়ি লোমশ বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। দুর্বোধ্য ভাষায় কলরব করতে করতে তারা শক্ত বেড়ি দিয়ে টারজনের হাত-পা বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে তুলে নিয়ে আর একটা বড় ঘরে ঢুকল। মেঝেতে কয়েক ফুট উঁচু বেদীর উপরকার মস্ত বড় সিংহাসনে বসে আছে একটি যুবতী নারী।