রক্ষীরা কিছুটা দূরে যেতেই নেমোন টারজনের দিকে তাকাল; টারজান হাসছে। বন্ধুত্বপূর্ণ সহজ সুরে টারজান বলল, এমনি করেই তুমি আরও অনেককে মারবে, আরও বেশি অসুখী হবে। তারপর একদিন আসবে তোমার মরবার পালা।
নেমোন শিউরে উঠল। আমার মরবার পালা! হ্যাঁ, অতীতে সকলেই নিহত হয়েছে, কাথুনির সব রাজা, সব রানী। কিন্তু আমার পালা এখনও আসেনি। যতদিন বেলথার বেঁচে আছে ততদিন আমিও বেঁচে আছি। একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, শিকারী সিংহটাকে এনে শিকারের গন্ধ শুকিয়ে দাও।
সমবেত সম্ভ্রান্ত নাগরিকবৃন্দ, সেনাদল ও জনতা দুই ভাগ হয়ে শিকারী সিংহ ও তাদের রক্ষীদের আসার পথ করে দিল। টারজান দেখতে পেল স্বর্ণ রজ্জুতে বাঁধা একটা প্রকাণ্ড সিংহ সেই পথে এগিয়ে আসছে, আর আটজন রক্ষী সে রজ্জ্বটা টান করে ধরে আছে।
অগ্নি-চক্ষু সেই শয়তান নেমোনের রথের দিকে এগিয়ে চলল; অনেক দূর থেকেই তার দুই কানের মাঝখানে একগুচ্ছ শ্বেত কেশর দেখেই টারজান তাকে চিনতে পারল। সিংহটি বেলথার!
একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক টারজনের কাছে এগিয়ে গেল। সে ফরডোস, গেমননের বাবা! চাপা নিচু স্বরে সে টারজানকে বলল, এতে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত, কিন্তু এটা করতে আমি বাধ্য। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, রানীর নামে বলছি, সকলে চুপ কর। কাথুনির রানী নেমোনের বড় শিকারের নিয়মাবলি সম্পর্কে অবহিত হওঃ সৈনিকদের মধ্যস্থিত পথের মাঝখান দিয়ে শিকার চলবে উত্তর দিকে; সে একশ’ পা এগিয়ে যাবার পরে রক্ষীরা শিকারী সিংহ বেলথারকে ছেড়ে দেবে। সিংহ যখন শিকারকে ধরে খেতে শুরু করবে তখন রক্ষীরা আবার বেলথারকে বেঁধে ফেলবে।
টারজনের দিকে ঘুরে বলল, যতক্ষণ বেলথার তোমাকে ধরতে না পারবে ততক্ষণ তুমি সোজা উত্তর দিকে ছুটতে থাকবে।
টারজান প্রশ্ন করল, আমি যদি তাকে এড়িয়ে পালাতে পারি? তাহলে মুক্তি পাব?
ফরডোস সক্ষেদে বলল, সব প্রস্তুত ইয়োর ম্যাজেস্টি। শিকার কি শুরু হবে?
চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেমোন বলল, সিংহকে আর একবার শিকার শুঁকতে দাও; তারপরই শুরু হোক শিকার।
রক্ষীরা বেলথারকে নিয়ে গেল টারজনের কাছে।
কাথুনির পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে চলেছে তারই একটা গহ্বরের মধ্যে ঘন ঝোপের ভিতরে আছে আর একটি সিংহ। বিশালদেহ সেই সিংহের গায়ের রং হলুদ, আর কেশর কালো। চোখ দুটি বুজে থাকলেও আসলে নুমা’ জেগেই আছে।
মাঠের মধ্যে টারজান তখন বর্শা-ঘেরা পথ ধরে ছুটছে। প্রতিটি পদক্ষেপ সে গুণছে, কারণ সে জানে, একশ’ পদক্ষেপ শেষ হতেই বেলথারকে ছেড়ে দেয়া হবে তার পিছনে। একটা ফন্দী সে এটেছে। পূর্ব দিকের নদী বরাবর রয়েছে একটা গভীর জঙ্গল। একবার সেখানে পৌঁছতে পারলেই সে নিরাপদ। একবার সেই সব গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়তে পারলে কোন সিংহ বা মানুষই অরণ্য-রাজকে ধরতে। পারবে না।
কিন্তু বেলথার তাকে ধরে ফেলার আগে সে কি জঙ্গলে পৌঁছতে পারবে? একশ’ পা আগে থেকে দৌড় শুরু করে যে কোন সাধারণ সিংহকে টারজান হয় তো দৌড়ে মেরে দিতে পারে; কিন্তু বেলথার তো। সাধারণ সিংহ নয়; কাথুনির সব শিকারী সিংহদের মধ্যে সে শ্রেষ্ঠ।
একশতম পদটি ফেলার সময় সে পরিপূর্ণ গতিতে একটা লাফ দিল। তার পিছনে শিকল ছাড়া সিংহের গর্জন; তার সঙ্গে মিশেছে জনতার হল্লা।
ছুটে আসছে বেলথার। তার পিছনে ছুটছে রানীর রথ; তারও পিছনে সম্ভ্রান্ত নাগরিক, সৈনিক ও সাধারণ মানুষের দল।
এই বুঝি বেলথার শিকারকে ধরে ফেলল।
পিছনে তাকিয়ে টারজানও বুঝল, তার শেষ ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। নদী এখনও দু’শ গজ দূরে, আর সিংহের দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ গজ।
টারজান ঘুরে দাঁড়াল। অপেক্ষা করতে লাগল। সে জানে এ পরিস্থিতিতে কি করতে হবে। আরও অনেকবার সে সিংহের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু আজ সে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। বুঝতে পারছে মৃত্যু অনিবার্য। তবু সে লড়াই করে মরবে।
শুরু হল সেই মৃত্যু-সংগ্রাম। গর্জন করে লাফিয়ে পড়ল বেলথার।
হঠাৎ ঘটল অঘটন। বেলথার প্রায় টারজনের উপর এসে পড়েছে এমন সময় একটি বাদামী দেহ বিদ্যুৎগতিতে তাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে এল পিছন থেকে; দুই পিছনের পায়ে ভর দিয়ে বেলথার টারজনের মুখোমুখি দাঁড়াতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল উদ্যত নখর ও থাবা সোনালী শরীর ও কালো কেশর ঢাকা একটি বিশাল সিংহ।
নবাগত সিংহটি বেথারের চাইতে বিশালকায় এবং অধিকতর শক্তিশালি; শক্তি ও হিংস্রতার একেবারে তুঙ্গে অবস্থিত। একবার সুযোগ পেতেই তার বিরাট চোয়াল সজোরে বসে গেল নেমোনের শিকারী সিংহের গলায়। তার বড় বড় দাঁত কেশরের ফাঁক দিয়ে বসে গেল বেথারের চামড়া ও মাংস ছিন্নভিন্ন করে। তারপর বিড়াল যেভাবে ইঁদুরকে ঝাঁকায় সেইভাবে বেলগারের ঘাড় মটকে তার পা ধরে ঝাঁকাতে লাগল।
মৃতদেহটাকে সজোরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিজয়ী সিংহটি কাথুনিবাসীদের দিকে মুখ খিঁচিয়ে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে ফিরে গেল টারজনের পাশে। টারজান সস্নেহে সোনালী সিংহ জাদ- বাজার কালো কেশরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
চারদিক নিস্তব্ধ। তারপরই শোনা গেল নারীকণ্ঠের এক বিচিত্র আর্তনাদ। নেমোনের আর্তনাদ। সোনার রথের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে পরিপূর্ণ নিঃশব্দের মধ্যে সে গিয়ে দাঁড়াল মৃত বেলথার-এর পাশে। বিস্মিত, নিশ্চল জনতা হাঁ করে তাকে দেখতে লাগল।