একটা ছোট খাবার ঘরে শুধুমাত্র টারজান ও রানী একত্রে আহার-পর্ব সমাধা করল। তারপর নেমোন তাকে নিয়ে গেল অতি-পরিচিত গজদন্ত কক্ষে।
রানী বলল, এরোট ও ম’দুজে বেঁচে নেই। টমোসকে কাজে পাঠিয়েছি। আজ রাতে কেউ আমাদের বিরক্ত করতে আসবে না।
টারজান স্থির দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, এই মিষ্টি মোহিনী নারীই হয়ে ওঠে রানী নেমোনের মত এক নিষ্ঠুর অত্যাচারী।
তারপর গভীর আবেগে বলে উঠল, আমাকে ভালবাস টারজান! আমাকে ভালবাস! ভালবাস! ভালবাস!
একটু একটু করে মেঝেতে নেমে গিয়ে নেমোন নতজানু হল টারজনের পদপ্রান্তে। অস্ফুট স্বরে বলল, হে পরমেশ্বর টুস!
জঙ্গল-রাজ তার দিকে তাকাল। এক রানী তার পদপ্রান্তে। মুহূর্তে তার মোহ ভঙ্গ হল। অস্পষ্ট শব্দ করে টারজান উঠে দাঁড়াল। নেমোন গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে; নিঃশব্দে সেখানেই পড়ে রইল। টারজান দরজার দিকে এগিয়েও ফিরে এল। নেমোনকে তুলে কোচে শুইয়ে দিল। গর্জে উঠল শৃঙ্খলাবদ্ধ বেলথার; সে গর্জনে ঘরটা কেঁপে উঠল।
নেমোন চোখ মেলল। মুহূর্তের জন্য তাকাল ঝুঁকে পড়া টারজনের দিকে। তারপরেই তার চোখে জ্বলে উঠল উন্মাদ ক্রোধের অগ্নিশিখা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় চীৎকার করে বলতে লাগল, আমার ভালবাসাকে তুমি প্রত্যাখ্যান করলে! আমাকে পায়ে ঠেললে! হায় টুস্! আর আমি মাথা নুইয়েছি তোমার পায়ে! এক লাফে ঘরের কোণে ঝোলানো ঘণ্টার কাছে গিয়ে কাঠি দিয়ে তিনবার তাতে আঘাত করল। কাংস্যধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে। তার সঙ্গে মিলল কুদ্ধ সিংহের গর্জন।
টারজান দরজার দিকে বাড়াল। ঠিক তখনই দরজাটা সপাটে খুলে গেল। দুই সম্ভ্রান্ত নাগরিকসহ বিশজন সৈনিক ঘরে ঢুকল।
নেমোন হুকুম করল, একে ধর! রানীর অপর শত্রুদের সঙ্গে একেও কারাগারে নিক্ষেপ কর।
টারজান নিরস্ত্র। একমাত্র সঙ্গী তরবারিখানাও গজদন্ত-কক্ষে ঢুকবার সময় খুলে রেখে এসেছে দরজার কাছে। বিশটা বর্শা তার দিকে উদ্যত; সে হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করল।
কারাগারে বসে টুডোস ও গেমনন বহুদূর থেকে সৈনিকদের পায়ের শব্দ শুনতে পেল। তাদের ঘরের সম্মুখে এসেই পায়ের শব্দ থেমে গেল। খোলা দরজা দিয়ে একজন ঘরে ঢুকল। সৈনিকদের হাতে মশাল ছিল না। তাই কেউ কাউকে চিনতে পারল না।
রক্ষী-সৈনিকরা চলে গেল নতুন বন্দী সানন্দে বলে উঠল, অভিবাদন জানাই টুডোস ও গেমনন!
টারজান! গেমনন উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠল।
তা ছাড়া আর কে হবে, টারজান বলল।
কেন তুমি এখানে এলে? টুডোস প্রশ্ন করল।
তা জানি না।
কঠিন হেসে টুভোস বলল, নেমোনের এই নরকে আশার কোন স্থান নেই।
টারজান মাথা নেড়ে বলল, হয়তো নেই, কিন্তু আমি আশা ছাড়ব না। কাল রাতে মন্দিরের কারাকক্ষে ডোরিয়াও তো সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তবু জারাটরের হাত থেকে সে তো পালাতে পেরেছে।
সে রহস্য আমার বুদ্ধির অতীত, গেমনন বলল।
টারজান ভরসা দিয়ে বলল, কিন্তু খুবই সরল। একটি বিশ্বস্ত বন্ধু এসে আমাকে জানিয়ে গেল যে ডোরিয়াকে বন্দী করে রাখা হয়েছে মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে তার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্যক্রমে কানিতে বড় বড় গাছপালার অভাব নেই; একটা তো মন্দিরের গায়েই দাঁড়িয়ে আছে; তার ডালপালা ছড়িয়ে আছে ডোরিয়ার কারা-কক্ষের জানালা পর্যন্ত। সেখানে পৌঁছে দেখলাম এরোট ডোরিয়াকে উত্তক্ত করছে। যে চামড়ার বস্তায় বেঁধে ডোরিয়াকে জারাটর যাত্রায় পাঠাবার কথা ছিল সেটাও হাতের কাছে পেয়ে গেলাম। এর চাইতে সরল ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে? যে যাত্রা ছিল ডোরিয়ার কপালে সেটাই জুটে গেল এরোটের ভাগ্যে।
টুডোস আবেগাপ্লুত গলায় বলে উঠল, তুমি তাকে উদ্ধার করেছ! কোথায় সে?
টারজান সাবধানে বলল, কাছে সরে এস। দেওয়ালও শত্রুতা করতে পারে। শোন গেমনন, ডোরিয়া নিরাপদ আশ্রয়েই আছে। কোন ভয় নেই।
গেমনন বলল, ডোরিয়া নিরাপদ! এবার সুখে মরতে পারব।
টুডোস অন্ধকারে হাতটা বাড়িয়ে টারজনের কাঁধে রেখে বলল, আমার কৃতজ্ঞতা জানাবার কোন উপায় নেই, কারণ জানাবার মত কোন ভাষা নেই।
ভোর হল।
দুপুরের পরে একটি বন্দী এসে টারজানকে নিয়ে গেল। সঙ্গের অফিসারটি তিন বন্দীরই পরিচিত; লোকটি ভাল, সহানুভূতিশীল।
রক্ষীদের ঘরে নিয়ে গিয়ে টারজানকে শক্ত শিকল দিয়ে বাঁধা হল। একটা সোনার কলার পরানো হল গলায়; তার দু’দিকে দুটো শিকলে ধরা রইল দু’জন সৈনিকের হাতে।
এত বেশি সতর্কতা কেন? টারজান জানতে চাইল।
অফিসার বলল, এটাই রীতি। রানীর শিকারকে সব সময় এইভাবে নিয়ে যাওয়া হয় ওথার উপত্যকার সিংহ-ক্ষেত্রে।
আর একবার টারজানকে হটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কাথুনির রানীর রথের কাছে। কিন্তু এবার সে হাঁটতে লাগল রথের পিছনে-দুই দীর্ঘদেহ সৈনিক ও জনবিশেক রক্ষী-পরিবেষ্টিত এক শৃঙ্খলাবদ্ধ। বন্দীরূপে। আর একবার স্বর্ণ-সেতু পার হয়ে ওথার উপত্যকার সিংহ-ক্ষেত্রে পৌঁছে গেল।
সঙ্গে এক বিরাট জনতা। যে মানুষ নেমোনের ভালবাসাকে পায়ে ঠেলেছে তার দুরবস্থা ও মৃত্যু দেখার জন্য রানী গোটা শহরকেই আমন্ত্রণ করে এনেছে।
নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নেমোন রক্ষীদের হুকুম দিল, বন্দীকে তার কাছে আনা হোক। টারজান এসে দাঁড়াল। নেমোন বলল, তোমরা যেতে পার; বন্দীর সঙ্গে আমি একা কথা বলতে চাই।