টারজান মাথা নাড়ল। আবার প্রশ্ন করল, আর আমার অন্য বন্ধুরা? তারা বেঁচে যাবে তো?
নেমোন উত্তর দিল, কাল রাতে তুমি আমার কাছে আসবে। তখন দেখব, নেমোনের প্রতি তুমি কি ব্যবহার কর; তখনই নেমোনও স্থির করবে, তোমার বন্ধুদের প্রতি কি রকম ব্যবহার সে করবে।
টুডোস-কন্যা ডোরিয়া হাত-পা বাঁধা অবস্থায় টুস-এর মন্দিরের তিনতলার একটা ঘরে চামড়ার স্কুপের উপর শুয়ে আছে।
এক সময় দরজা খুলে গেল। মশালের আলোয় ঘর আলোকিত হল। ঘরে ঢুকল এরোট। দরজা বন্ধ করে দিল। দেওয়ালের গর্তে মশালটা বসিয়ে রাখল।
বলল, আহা, ডোরিয়া! কোন্ দুর্ভাগ্য তোমাকে এখানে এনে হাজির করেছে?
ডোরিয়া বলল, এ প্রশ্নের জবাব তো মহামান্য এরোটই আমার চাইতে ভাল জানে।
হ্যাঁ, আমি জানি। আমিই তোমাকে এখানে আনিয়েছি; তোমার বাবাকে বন্দী করেছি; আর গেমননকেও সেখানে পাঠিয়েছি।
গেমনন বন্দী! মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠল। ধীরে ধীরে নিজেকে সংযত করে শুধাল, আমাকে নিয়ে কি করবে?
এরোট জবাব দিল, নেমোনের হুকুমে তোমাকে জারাটরের কাছে সমর্পণ করা হবে। তরপর হেসে বলল, কালই তোমার মৃত্যু হবে।
উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে এরোট ডোরিয়ার পায়ের বেড়ি খুলে দিল। তাকে বলল, তুমি নেমোনের চাইতেও সুন্দরী।
জানালার দিক থেকে একটা অস্পষ্ট গর্জন ভেসে এল। ডোরিয়া সেদিকে তাকাতেই এরোটের মুখ ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল। তার ভীরু বুক ভয়ে উথাল-পাথাল। এক লাফে সে দরজার দিকে ছুটে গেল।
যে শোভাযাত্রা মৃত্যুপথযাত্রী ডোরিয়াকে নিয়ে জারাটরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে, খুবই সকালেই সেটা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। ওনৃথার উপত্যকার শেষ প্রান্তে অবস্থিত পর্বতমালায় জারাটরের অবস্থান; কাথুনি শহর থেকে ষোল মাইল দূরে। জারাটরের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আবার শহরে ফিরে আসতে বেশ রাত হয়ে যাবে। তাই শত শত মশালধারী ক্রীতদাস যাবে শোভাযাত্রার সঙ্গে।
নেমোন টারজানকে শুধাল, জারাটরকে কখনও দেখেছ?
না।
জারার একটি পবিত্র পর্বত; কাথুনির রাজা ও রানীদের শত্রুদের জন্য টুস্ সেটা সৃষ্টি করেছে; সারা পৃথিবীতে এরকম দ্বিতীয়টি নেই।
টারজান বলল, সেটা দেখলে আমার ভালই লাগবে।
দুপুরে জলপানের জন্য যাত্রার বিরতি হল। আধঘণ্টা পরেই আবার শুরু হল যাত্রা। অচিরেই তারা পর্বতমালার ভিতরে ঢুকে পাকানো পথে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল।
ক্রমে গন্ধকের ধোয়া এসে নাকে লাগল। একটু পরেই আগ্নেয়গিরিতে চড়ে পুরো দলটাই প্রকাণ্ড বড় এক গিরি-বিবরের প্রান্তে পৌঁছে গেল। অনেক নিচে গলিত পাথর টগবগ করে ফুটছে; আগুনের শিখা ছিটকে উঠছে; ছিটকে বের হচ্ছে বাম্প ও হলুদ ধূমের কুণ্ডলী। সে দৃশ্য যেমন আকর্ষক তেমনই ভয়াল, ভয়ংকর। কাথুনি সৃষ্টির আগে থেকেই সব ছোট ছোট শিখরের ঊর্ধ্বে একক মহত্ত্বে দাঁড়িয়ে আছে জারাটর। দুই হাত এক করে নত মস্তকে টারজান অপলক নয়নে তাকিয়ে রইল সেই বিক্ষুব্ধ নরকের দিকে।
দু’জন সন্ন্যাসী ডোরিয়ার চামড়ার ভিতরে সেলাই করা দেহটাকে রথ থেকে তুলে নিয়ে আগ্নেয়গিরির মুখ-বিবরের প্রান্তে রানীর পায়ের কাছে রাখল। তারপর ডজনখানেক পুরোহিত তাকে ঘিরে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগল।
নেমোন যাতে টুডোস ও গেমননের যন্ত্রণাকে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে সে জন্য তাদের দু’জনকেই ঘটনাস্থলের আরও কাছে নিয়ে আসা হল; কারণ এ অনুষ্ঠান তো শুধু মাত্র তাদের শাস্তি নয়, রানীর উপভোগের বিষয়ও বটে।
পুরোহিত দু’জন ডোরিয়ার দেহটাকে তুলে ফুটন্ত আগ্নেয়গিরির মুখে ছুঁড়ে ফেলতে উদ্যত হতেই সে চীৎকার করে বলে উঠল, থাম! বিশ্বাসঘাতক টুডোসের কন্যার অপরূপ রূপ-লাবণ্য আমরা দেখতে চাই; তার বাবা ও প্রেমিকও দুই চোখ ভরে তাকে দেখুক; আর তাদের দেখে সকলে বুঝুক যে নেমোনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার ফল কী ভয়ংকর। টারজান–৩০ক
একজন পুরোহিত ছুরি হাতে নিয়ে থলের সেলাইটা কেটে ফেলল; সিংহের বাদামী চামড়ার নিচে নিশ্চল দেহটার রূপরেখার উপর টুডোস ও গেমননের দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল তাদের কপালে; কঠিন হয়ে উঠল তাদের চোয়াল ও মুষ্টি।
পুরোহিতরা থলির চামড়াটাকে একদিক থেকে গুটিয়ে তুলে নিতেই মৃতদেহটা গড়িয়ে মাটিতে পড়ল সকলের চোখের সামনে। শোনা গেল একান্ত বিস্ময়ের একটা অব্যক্ত ধ্বনি। তীব্র রোষে চীৎকার করে উঠল নেমোন। দেহটা এরোটের মৃতদেহ।
এ সবের অর্থ কি? রানীর কণ্ঠস্বর তার কোষবদ্ধ ইস্পাতের মতই শীতল।
বিরক্ত মুখভঙ্গী করে নেমোন হুকুম দিল, এরোটের দেহটাকে জারাটরে মুখে ফেলে দেয়া হোক; আর অগ্নিগর্ভ মুখ-বিবর যখন দেহটাকে গিলে ফেলল তখন সে আবার হুকুম দিল, এই মুহূর্তে ফিরে চল কাথুনিতে।
সমবেত সকলকে সঙ্গে নিয়ে রানীর রথ পাহাড়ের পথে ঘুরে ঘুরে নামতে লাগল। রানী একেবারে নীরব। মাঝে মাঝে শুধু তাকিয়ে দেখছে রথের পাশের চলমান দানব-মূর্তিটাকে।
একঘেয়ে ক্লান্ত কাথুনি-প্রত্যাবর্তন এক সময় শেষ হল। স্বর্ণ-সেতু পার হয়ে সকলে শহরে ঢুকল। রানী হুকুম দিল, ডোরিয়াকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হোক।
টুডোস ও গেমননকে পাঠান হলো কারাকক্ষে। টারজনের প্রতি হুকুম হল, প্রাসাদে গিয়ে রানীর সঙ্গে খানা খেতে হবে। টমোসকে বলা হল ডোরিয়াকে খুঁজে বের করতে; না পারলে তার কপাল মন্দ!