ও দুটোই সমান শক্ত; ফোবেগ মন্তব্য করল; তবু আপাতত জানাই বিদায় ও শুভ-কামনা।
সৈনিকটির মাথার উপরকার একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়ে টারজান রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিস্ময়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ফোবেগ মন্দিরে তার বাসার দিকে ফিরে গেল।
অনেক রাতে ফোবেগ এল টারজনের সঙ্গে দেখা করতে।
টারজান জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? তুমি কি দুঃসংবাদ এনেছ?
খুব খারাপ খবর, ফোবেগ জবাব দিল। গেমনন, টুডোস ও তাদের বেশ কিছু বন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। প্রাসাদের অন্ধকূপে আটক করা হয়েছে। ডোরিয়াকে ধরে নিয়ে মন্দিরে বন্দী করা হয়েছে। তোমাকেও বাইরে দেখতে পাব আশা করি নি। যাইহোক, যদি কাথুনি থেকে পালাতে পার তো এই মুহূর্তে পালাও। যে কোন মুহূর্তে রানীর মত পাল্টে যেতে পারে; সে এখন রেগে কাঁই হয়ে আছে।
টারজান বলল, ধন্যবাদ ফোবেগ। কিন্তু যাবার আগে বলে যাও ডোরিয়াকে কোথায় বন্দী করে রাখা হয়েছে।
আজ সন্ধ্যায় যে বাড়িটার দরজায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম তার পিছন দিকে মন্দিরের তিন তলায়।
টারজান ফোবেগের সঙ্গে ফটক পর্যন্ত গিয়ে পথে নামল। কোথায় যাচ্ছ? ফোবেগ জানতে চাইল। রাজ প্রাসাদে।
ফোবেগ বাধা দিয়ে বলল, তুমিও পাগল হয়েছ দেখছি। কিন্তু ততক্ষণে টারজান পথে নেমে দ্রুত পদক্ষেপে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলেছে।
বেশ রাত হয়েছে; কিন্তু প্রাসাদ-রক্ষীরা এতদিন টারজানকে ভালভাবেই চিনে নিয়েছে; তাই কেউ তাকে বাধা দিল না। দরজা খুলে গেলে টারজান অতি-পরিচিত গজদন্ত-কক্ষে পা বাড়াল।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রানী। চুল এলোমেলো, মুখ ঈষৎ রক্তিম। বোঝা যাচ্ছে, ঘুম থেকে সদ্য উঠে এসেছে। ক্রীতদাসীকে দরজাটা বন্ধ করে ঘর থেকে চলে যেতে বলল। তারপর নরম কোচে বসে টারজানকে ইশারায় পাশে বসতে বলল। তুমি আসায় বড় খুশি হয়েছি। ঘুমতে পরছিলাম না; কেবলি তোমার কথা মনে হচ্ছিল। এবার বল তো তুমি কেন এসেছ? তুমিও কি আমার কথাই ভাবছিলে?
টারজান জবাব দিল, তোমার কথাই ভাবছিলাম, নেমোন তুমি আমাকে সাহায্য করবে?
রানী নরম গলায় বলল, শুধু তোমার চাওয়ার অপেক্ষা। তোমাকে অদেয় নেমোনের, কিছুই নেই।
দুই বাহু মেলে দিয়ে সে টারজনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, টারজান! প্রায় চাপা কান্নার সুর তার গলায়। আর তখনই ঘরের দূর প্রান্তের সেই মারাত্মক দরজাটা খুলে গেল; পাথরের মেঝেতে ধাতুনির্মিত লাঠির খট খট শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে দু’জনই সোজা হয়ে বসে তাকাল ম’দুজের ক্রুব্ধ মুখের দিকে।
বিকৃতদর্শন বুড়ি কর্কশ কণ্ঠে চীৎকার করে বলল! বোকার ডিম কোথাকার! লোকটাকে বাইরে পাঠিয়ে দে! নইলে চোখের সামনেই তার মৃত্যু তোকে দেখতে হবে।
নেমোন লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। বুড়ি তখন তীব্র রোষে থর থর করে কাঁপছে। ঠাণ্ডা গলায় নেমোন বলল, তুমি অনেক দূর এগিয়েছ ম’দুজে। তোমার ঘরে চয়ে যাও; মনে রেখো যে আমিই রাণী।
বীভৎস বুড়ি ধারালো গলায় ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, রানী! তোর সব পরিচয় ওকে বলে দেব।
নেমোন দ্রুত পায়ে বুড়ির দিকে এগিয়ে গেল। যাবার সময় নিচু টুলটার উপর ঝুঁকে পড়ে সেখান থেকে কি যেন তুলে নিল। সহসা বুড়ি আর্তনাদ করে কুঁকড়ে সরে গেল কিন্তু ঘর থেকে পালিয়ে যাবার আগেই নেমোন ঝাঁপিয়ে পড়ে তার চুলের মুঠি চেপে ধরল। হাতের লাঠি তুলে মদুজে রানীকে আঘাত করল। তাতে রানীর ক্রোধের আগুন যেন ঘৃতাহুতি পড়ল।
চীৎকার করে বলল, চিরকাল তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে এসেছ-তুমি আর পাপাত্মা টমোস। সব সুখ থেকে তোমরা আমাকে বঞ্চিত করেছ, আর তার জন্য এই নাও! মুখের কথা শেষ হতে না হতেই ছুরির সুতীক্ষ্ণ ফলাটাকে সে বসিয়ে দিল আর্তকণ্ঠ বুড়ির লাল বক্ষে; আরও নাও! এই নাও! এই নাও! প্রতি বারেই ছুরির ফলাটা গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে রানী নেমোনের মুখের কথা আর বুকের ব্যথার বিষকে তীব্রতর করে তুলল।
ধীরে ধীরে মদুজের আর্তনাদ থেমে গেল; সে,মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
নেমোন আবার টারজনের মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল, হ্যাঁ, তুমি সাহায্যের কথা কি বলছিলে, সেটা আর একবার বল; নেমোন আজ মুক্ত হস্ত।
টারজান বলল, তোমার দরবারের একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক আমার প্রতি খুবই সদয় ব্যবহার করেছে। আজ সে বিপদগ্রস্ত; তুমি তাকে বাঁচাও। এটাই আমার প্রার্থনা।
নেমোনের ভুরু কুঞ্চিত হল। কে সে?
গেমনন। টুডোস, টুডোসের কন্যা ও কয়েকজন বন্ধুসহ সে গ্রেফতার হয়েছে। এটা আমার সর্বনাশ করার ষড়যন্ত্র মাত্র।
হঠাৎ তীব্র ক্রোধে জ্বলে উঠে রানী চীৎকার করে বলল, তোমার এত সাহস যে বিশ্বাসঘাতকদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ! কিন্তু এ সবের কারণ আমি জানি; তুমি ডোরিয়াকে ভালবাস।
তাকে আমি ভালবাসি না; তাকে ভালবাসে গেমনন। তুমি তাদের সুখী হতে দাও নেমোন।
নেমোন সরে গেল; কোচে বসে দুই হাতে মুখ ঢাকল; চাপা কান্নায় তার দুই কাঁধ কাঁপতে লাগল; তা দেখে টারজনের দয়া হল; তাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলার অবকাশই পেল না; নেমোন হঠাৎ তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল; ভেজা চোখ দুটি চকচক্ করছে। চীৎকার করে বলে উঠল, ডোরিয়া মেয়েটা মরবে! কাল জারাটর তাকে গ্রহণ করবে!
কখন তার মৃত্যু ঘটবে? টারজান প্রশ্ন করল।
আজ রাতে চামড়ায় ভরে সেলাই করে কাল তাকে নিয়ে যাওয়া হবে জারাটরের কাছে। তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে, বুঝলে।