সহসা মন্ত্র থেমে গেল। রানী উঠে দাঁড়াল। রুগ্ন ও বৃদ্ধ সিংহটার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে বলতে লাগল, হে টু,! নেমিেন তোমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে; তোমার জন্য সে নৈবেদ্যও এনেছে। নেমোনের সে নৈবেদ্য তুমি গ্রহণ কর, তাকে আশীর্বাদ কর। তার বন্ধুদের তুমি রক্ষা কর, আর ধ্বংস কর তার শত্রুদের। হে টুস, তাকে দাও সেই বস্তু যা তার অন্তরের প্রধান কামনা-তাকে ভালবাসা দাও, পৃথিবীর সেই একটি মাত্র মানুষের ভালবাসা তাকে দাও যাকে সে ভালবেসেছে। খাঁচার ফাঁক দিয়ে সিংহটা তার। দিকে তাকাল।
নেমোন অলস ভঙ্গীতে সোনার সিংহাসনে গিয়ে বসল। খাঁচার অপর পাশে দরজা দিয়ে পুরোহিতরা মেয়েটিকে বের করে নিয়ে গেল।
নিঃশব্দে কাঠ হয়ে সিংহাসনে বসে নেমোন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খাঁচার ভিতরের সিংহটার দিকে। পুরোহিতরা এবং নাগরিকদের অনেকেই এক ঘেয়ে সুরে মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে। টারজান পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে তারা সিংহের কাছেই প্রার্থনা করছে, কারণ সকলেরই দৃষ্টি সেই বৃদ্ধ পশুরাজের দিকে। কাথুনিতে প্রথম আসার পরে যে সব প্রশ্ন তাকে বিচলিত করেছিল সে সব কিছুর জবাব সে এতক্ষণে খুঁজে পেয়েছে। ফোবেগের বিচিত্র সব শপথ, তার দেবতার লেজে পা দেবার কথা-সবই সে। বুঝতে পারছে।
সহসা একটা উজ্জ্বল আলোর রেখা উপর থেকে খাঁচার মধ্যে নেমে এসে জানোয়ার-দেবতাটিকে সোনালী আলোয় ভাসিয়ে দিল। সিংহটা এতক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল; এবার সে থেমে উপরের দিকে তাকাল, তার দুটি চোয়াল ফাঁক হয়ে গেল, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে লালা গড়াতে লাগল। সমবেত দর্শকবৃন্দ এক সুরে মন্ত্র উচ্চারণ করল। কি ঘটতে যাচ্ছে সেটা আংশিক আঁচ করে টারজান সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু তার মনে যাই থাকুক, মুহূর্তের মধ্যে যে শোচনীয় ঘটনা ঘটে গেল তাকে রোধ করার চেষ্টায় সে তখন বড় বেশি দেরী করে ফেলেছে। সে দাঁড়ানোমাত্রই ক্রীতদাসী মেয়েটির দেহ উপর থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে অপেক্ষামান সিংহের থাবার মধ্যে বন্দী হল। নরমাংসাশীর ভয়ঙ্কর গর্জনের সঙ্গে মিশে গেল একটি মাত্র হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। পরমুহূর্তেই সে আর্তনাদ বাতাসে মিলিয়ে গেল। মেয়েটি মারা গেল।
বিরক্তিতে ক্ষোভে টারজান মন্দির থেকে বেরিয়ে তাজা বাতাস ও সূর্যের আলোয় এসে দাঁড়াল, আর তখনই ফটক থেকে জনৈক সৈনিক অস্ফুট স্বরে তার নাম ধরে ডাকল। সেই দিকে তাকিয়ে সে ফোবেগকে দেখতে পেল।
ঠোঁট নড়ে-কি নড়ে না এমনি ভাবে নিচু গলায় ফোবেগ বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে! সূর্যাস্তের দু’ঘণ্টা পরে মন্দিরের পিছন দিকে এসো। এখন কোন জবাব দিও না; যদি আমার কথা শুনে থাক আর আসতে রাজী থাক তাহলে শুধু ডানদিকে মাথাটা নাড়াও।
টারজান সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই রাজকীয় শোভাযাত্রা সারিবদ্ধভাবে মন্দির থেকে বের হতে লাগল; আর সে সুযোগ মত নেমোনের ঠিক পিছনে তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। রানী তখন শান্ত, আত্মস্থ। প্রাসাদে পৌঁছে সে টারজানসহ সকলকেই ছুটি দিল।
ওদিকে পিতৃগৃহে গেমনন অস্থিরভাবে মেঝেতে পায়চারি করছে। একটা পাথরের বেঞ্চিতে টারজান অর্ধশায়িত অবস্থায় বসে আছে। বন্ধু যে খুবই চিন্তিত তা সে বুঝতে পারছে। তবু গেমননের মনকে বিষয়ান্তরে নিয়ে যাবার জন্য মন্দিরের আজকের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলল, মন্দিরটা চমৎকার, কিন্তু আজ সেখানে যে নিষ্ঠুর অনুষ্ঠান হতে দেখলাম সেটা ওখানে মানায় না।
গেমনন বলল, টু-এর কাছে নৈবেদ্য দেয়া কিন্তু অন্যায় কাজ নয়; কিন্তু একটা সত্যিকারের অন্যায়কে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ঐ মন্দিরে। মন্দিরই কোনখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে নেমোনের ভাই আলেক্সটারকে; সে সেখানে পচে মরছে, আর ব্যাভিচারী টমোস ও নিষ্ঠুর ম’দুজে কাথুনিকে শাসন করছে। উন্মাদিনী নেমোনের বকলমে।
অনেকেই এ ব্যবস্থার পরিবর্তন চায়, আলেক্সটারকে সিংহাসনে বসাতে চায় কিন্তু ভয়ংকর ত্রিমূর্তির ক্রোধ-বহ্নিকে তারা ভয় করে। তাই দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই করা হচ্ছে না।
খেতে খেতেই টারজান ফোবেগের সঙ্গে দেখা করার মতলব আঁটতে লাগল। যেমন করেই হোক তাকে একাই যেতে হবে, আর যেতে হবে গেমননকে না জানিয়ে গোপনে।
খাবার পরেই ক্লান্তির অজুহাতে নিজের ঘরে চলে গেল টারজান। সামনেই বাগান। সেখানে বড় বড় গাছেরও অভাব নেই। একটু পরেই দেখা গেল জঙ্গলের রাজা ডাল থেকে ডালে ঝুলতে ঝুলতে টুস-এর স্বর্ণ মন্দিরের দিকে এগিয়ে চলেছে।
মন্দিরের পিছনকার একটা গাছে পৌঁছেই সে দেখতে পেল, দীর্ঘকায় ফোবেগ একটা গাছের ছায়ায় অপেক্ষা করছে। ঠিক তার সম্মুখে নিঃশব্দে গাছ থেকে নেমে সে ফোবেগকে অবাক করে দিল।
ফোবেগ বলল, তুমি এসে গেছ ভালই হয়েছে। অনেক কথা বলার আছে। ইতোমধ্যে আমি আরও অনেক কিছু জেনেছি।
টারজান বলল, আমি কান পেতে আছি।
ফোবেগ বলতে আরম্ভ করল, রানীর দাসীদের একজন আড়াল থেকে নেমেমান ও টমোসের কথা বার্তা শুনে ফেলেছে। টমোস অভিযোগ করেছে, তুমি, গেমনন ও টুভোস নাকি রানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছ। টমোস আরও বলেছে যে ডোরিয়া খুব সুন্দরী, আর তুমি তার প্রেমে পড়েছ।
তাহলে এবার আমি ফিরে যাব গেমনের কাছে; তাকে সতর্ক করে দেব। হয় তো নেমোনকে নরম করতে বা বুদ্ধিতে হারিয়ে দিতে কোন পথে আমরা বের করতে পারব।