কথা বলল টারজান, নেমোনকে দেখে আমারু কিন্তু মনে হয়েছে যে সেও ঐ বুড়ির মৃত্যু চায়।
গেমননের বাবা বলল, ঠিক কথা, কিন্তু সে কাজ করার সাহস তার নেই। ঐ বুড়ি ডাইনি আর টমোস মিলে রানীর মাথার উপর এমন একটা ভয়ের খড়গ ঝুলিয়ে রেখেছ যে তাদের কাউকে ধ্বংস করার সাহস তার হবে না। তবু আমি স্থির জানি সে ওদের দুজনকেই ঘৃণা করে, আর সে যাকে ঘৃণা করে তাকে কদাপি বেঁচে থাকতে দেয় না।
গেমনন বলল, শোনা যায় যে তারা দুজনই রানীর জন্মের গোপন কথাটি জানে, আর সে কথা জনসমক্ষে প্রচার হলে রানীর সর্বনাশ অনিবার্য। কিন্তু সে কথা এখান থাক; তুমি নেমোনের সঙ্গে কথা বলার আগে আমি টুডোস-এর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি না।
টারজান ও গেমননের শহরে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল; তখনি টারজানকে নিয়ে নেমোনের কাছে যেতে হবে। একদল রক্ষী-সৈনিক নিয়ে তারা প্রাসাদে পৌঁছামাত্রই রানীর কাছ থেকে শুধুমাত্র টারজনের ডাক পড়ল।
কোথায় ছিলে? রানী প্রশ্ন করল।
টারজান বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
কাল রাতে কোথায় ছিলে?
গেমননের বাড়িতে, টারজান জবাব দিল!
ডোরিয়ার সঙ্গে কাটিয়েছ? নেমোনের গলায় অভিযোগ।
টারজান বলল, না সে আগের রাতে। টুডোস-এর বাড়িতে গিয়েছিলে কেন? এবার রানীর গলায় কোন অভিযোগ নেই।
কি জান, পাছে আমি পালিয়ে যাই বা আমার কোন বিপদ ঘটে এই আশংকায় গেমনন আমাকে একলা ছেড়ে দিতে সাহস পায় না; তাই সে যেখানেই যায় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যায়।
এবার রানী শান্ত গলায় বলল, আমাকে বলা হয়েছিল যে তুমি ডোরিয়াকে ভালবাস, কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি নি। সে কি খুব সুন্দরী?
টারজান হেসে বলল, হয় তো গেমনন তাই মনে করে।
রানী তবু জানতে চাইল, তুমি কি মনে কর?
কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে টারজান বলল, তা দেখতে মন্দ নয়।
নেমোনের মত সুন্দরী কি?
কোথায় সূর্য, আর কোথায় দূরতম নক্ষত্র!
এ জবাবে নেমোন খুশি হল। টারজনের আরও কাছে গিয়ে মোহিনী কটাক্ষে বলল, তুমি কি আমাকে সুন্দরী ভাব?
তুমি খুব সুন্দরী। টারজান সত্য কথাই বলল।
টারজনের গা ঘেঁষে বসে মসৃণ, গরম হাতে তার গলাটা জড়িয়ে ধরে নেমোন ফিসফিসিয়ে বলল, আমাকে ভালবাস টারজান?
ঘরের দূর কোণে শিকলের ঝন্ঝন্ শব্দ হল; হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বেলথার ভয়ংকরভাবে গর্জে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে নেমোন টারজনের কাছ থেকে সরে গেল; তার শরীরের ভিতরে একটা শিহরণ বয়ে গেল;
মুখে দেখা দিল কিছুটা আতংক, কিছুটা ক্রোধ।
ঈষৎ কেঁপে উঠে বিরক্ত গলায় রানী বলল, বেথারের মনে ঈর্ষা জেগেছ। এই পশুটার জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের কোথায় যেন একটা আশ্চর্য, বন্ধন আছে। সেটা যে কি আমি জানি না। যদি জানতে পারতাম! তার চোখে ফুটে উঠল উন্মাদের ঝিলিক। এক এক সময় মনে হয় টু হয় তো ওকেই আমার স্বামী করে পাঠিয়েছে; কখনও মনে হয় অন্যরূপে ও যেন আমারই প্রকাশ। তবে একটা কথা জানি; যেদিন বেলথার মরবে, সেদিন আমারও মৃত্যু হবে।
বিষণ্ণ চোখ তুলে সে টারজনের দিকে তাকাল; বলল, বন্ধু আমার, চল, দু’জনে মিলে মন্দিরে যাই; টু হয়তো নেমোনের অন্তরের সব প্রশ্নের জবাব দেবে।
সিলিং থেকে ঝোলানো ব্রোঞ্জের একটা থালায় আঘাত করতেই তার শব্দ সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। একটা দরজা খুলে জনৈক সম্ভ্রান্ত নাগরিক দ্বারপথেই আভূমি নত হল।
রানী হুকুম দিল, রক্ষীদের খবর দাও। আমরা মন্দিরে যাব টুকে দর্শন করতে।
শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে মন্দিরের দিকে বর্শাগ্রে পতাকা উড়িয়ে মার্চ করে চলেছে সৈনিক দল, ঝলমলে পরিচ্ছদে শোভিত হয়ে চলেছে নাগরিকগণ, সিংহবাহিত সোনার রথে চলেছে রাণী। রথের এক পাশে হাঁটছে টমোস, অন্য পাশে এরোটের জায়গায় হেঁটে চলেছে টারজান।
মন্দিরের কাছে পৌঁছে সে দেখতে পেল, শিকলে বাঁধা একটি ক্রীতদাসী মেয়েকে নিয়ে একদল পুরোহিত এগিয়ে আসছে। মেয়েটিকে নেমোনের রথের কাছে এনে পুরোহিতরা দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু মন্ত্রতন্ত্র উচ্চারণ করার পরে মেয়েটিকে রথের পিছনে বেঁধে দিল। আবার শোভাযাত্রা শুরু হল। পুরোহিতরা মেয়েটির পিছন পিছন হাঁটতে লাগল।
মন্দিরের সামনে এসে নেমোন রথ থেকে নেমে প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে সুসজ্জিত দ্বারপথে উঠে গেল। তার পিছনে পুরোহিতরা; সেই সঙ্গে ভীত, বিস্ফারিত নেত্র, ক্রন্দনরতা মেয়েটিও উঠল। তারপর উঠে এল পরিষদবর্গ। রক্ষী সৈনিকদল বাইরেই অপেক্ষা করতে লাগল।
মন্দিরটি তিন-তলা; মাঝখানে একটা সুউচ্চ গম্বুজ। গম্বুজের ভিতরটা সোনায় মোড়া; স্তম্ভগুলো ও সোনার; দেওয়ালে বিচিত্রবর্ণের কারুকার্য। প্রধান ফটকের ঠিক বিপরীত দিকে উঁচু বেদীর উপর একটা বড় খাঁচা, আর খাঁচার দুই পাশে দুটো নিরেট সোনার সিংহ-মূর্তি দণ্ডায়মান। বেদীর সামনে পাথরের রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা সিংহাসন এবং খাঁচার মুখোমুখি একসারি পাথরের বেঞ্চি।
নেমোন এগিয়ে এসে সিংহাসনে বসল; সম্ভ্রান্ত নাগরিকরা বসল বেঞ্চিতে। টারজনের দিকে কেউ নজরই দিল না; সে রয়ে গেল রেলিংয়ের বাইরে।
টারজান দেখল, পুরোহিতরা মেয়েটিকে নিয়ে বেদীতে উঠল আর তাদের পিছনে খাঁচার মধ্যে উঠে এল একটি বৃদ্ধ ও রুগ্ন সিংহ। প্রধান পুরোহিত সুরেলা গলায় অর্থহীন মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল; অন্য পুরোহিতরা মাঝে মাঝে তার সঙ্গে গলা মেলাল। নেমোন সাগ্রহে সামনে ঝুঁকে বসল; তার দুই চোখ বৃদ্ধ সিংহের উপর স্থিরনিবদ্ধ।