নয়?
আমি তোমাকে পছন্দ করি। নেমোনের কণ্ঠস্বর নিচু ও আদর মাখানো।
এবার আমার প্রশ্নের জবাব দাও। নিজের দেশে তুমি কি একজন সিংহ-পুরুষ?
সেখানে আমি একজন সম্ভ্রান্ত লোক; তবে সেটা নিজের গুণে নয়, বংশগত অধিকারে।
নেমোন উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, আঃ! আমিও তাই ভেবেছিলাম; তুমি একটি সিংহ-পুরুষ!
তাতে কি হল? টারজান প্রশ্ন করল।
নেমোন হাতটা বাড়িয়ে টারজনের হাতের উপর রাখল; নরম ও গরম হাতখানা একটু কেঁপে উঠল। নেমোন বলল, আমি তোমাকে মুক্তি দেব, কিন্তু এক শর্তে।
সেটা কি?
তুমি এখানেই থাকবে; ওথারকে-আমাকে ছেড়ে যাবে না। রানীর কণ্ঠস্বর আগ্রহে ভাঙা।
টারজান চুপ। এ কথা সে দিতে পারে না বলেই কথা বলল না।
নেমোন ফিসফিস্ করে বলল, আমি তোমাকে কাথুনির সম্ভ্রান্ত নাগরিক করে দেব। সোনার শিরস্ত্রাণ, হাতির দাঁতের বক্ষস্ত্রাণ বানিয়ে দেব। তোমাকে সিংহ দেব পঞ্চাশটা, একশ’টা-যত চাও। তুমি হবে আমার দরবারের ধনীশ্রেষ্ঠ এবং সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী।
আর ঠিক তখনই দূর প্রান্তের একটা দরজা খুলে ঘরে ঢুকল এক নিগ্রো রমণী। এক সময়ে সে খুবই লম্বা ছিল। এখন বয়সের ভারে ন্যুজ দেহ, মাথায় যৎসামান্য সাদা চুল। শুকনো ঠোঁট দুটি বেঁকে গিয়ে দাঁত-বিহীন মাড়ি বেরিয়ে পড়েছে। দ্বারপথে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছে যেন পক্ষাঘাতে পঙ্গু একটি বিকৃতদর্শন ডাইনি।
বাধা পেয়ে নেমোন শরীরটাকে সোজা করে চারদিকে তাকাল।
বুড়ি ডাইনি মেঝেতে লাঠিটা ঠুকতে লাগল, আর অদ্ভুত ভয়ংকর একটা পুতুলের মত মাথাটা অবিরাম নাড়তে লাগল। ঠোঁট দুটি তখনও বেঁকে আছে। ক্যাক-ক্যাক করে বলল, আয়! আয়! আয়!
নেমোন লাফ দিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চীৎকার করে বলল, ম’দুজে! আমি তোমাকে মেরে ফেলব; টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব! চলে যাও এখান থেকে।
বুড়ি কিন্তু তবু লাঠি ঠঠকিয়ে বলতে লাগল, আয়! আয়! আয়!
ধীরে ধীরে নেমোন তার দিকে এগিয়ে গেল। যে কোন অদৃশ্য শক্তির দুর্বার টানে সে ঘরটা পার হয়ে গেল; বুড়ি সরে দাঁড়াল; আর রানী দরজা পার হয়ে অন্ধকার বারান্দায় মিশে গেল। একবার টারজনের দিকে তাকিয়ে বুড়িও দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
নেমোনের সঙ্গে সঙ্গে টারজানও উঠে দাঁড়িয়েছিল। মুহূর্তমাত্র ইতস্তত করে রানী ও বুড়িকে অনুসরণ করে সেও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শিকল-বাঁধা সিংহটা বজ্রের মত হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠল।
পরদিন সকালে বাসায় ঢুকেই গেমনন দেখল, বসার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে টারজান প্রাসাদ চত্বরের দিকে তাকিয়ে আছে।
বলল, সকালেই তোমাকে দেখতে পেয়ে খুশি হয়েছি।
নিশ্চয় বিস্মিতও হয়েছ? জঙ্গলের রাজা বলল।
গেমনন জবাব দিল, তোমাকে আর কোনদিন না দেখতে পেলেও বিস্মিত হতাম না। তারপর রানী কি বলল? আর এবোট, সে নিশ্চয় তোমাকে সেখানে দেখে খুশি হয় নি?
টারজান হাসল, তা হয় কি? তবে রানী তো তাকে সঙ্গে সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
আর সারা সময়টা তুমি তার সঙ্গে একা ছিলে? গেমনের কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর।
টারজান তার কথাকে সংশোধন করে দিয়ে বলল, না। বেলথার ও আমি ছিলাম।
হ্যাঁ, বেলথারের থাকারই কথা। আচ্ছা! তাহলে ম’দুজেকেও দেখেছ? সে নিশ্চয় জামাই-আদর করে নি।
টারজান বলল, না। আসলে সে আমার দিকে তাকায়ই নি। শুধু নেমোনকে বেরিয়ে যেতে বলল। আর নেমোনও বেরিয়ে গেল। কালো বুড়িটার হুকুম সে সহজেই মেনে নিল।
গেমনন বলতে লাগল, মদুজে সম্পর্কে অনেক কথা এখানে চালু আছে। তার মধ্যে একটা হল, নেমোনের ঠাকুর্দার আমল থেকেই ম’দুজে রাজবাড়িতে ‘ক্রীতদাসী হয়ে আছে; তকালীন রাজার ছেলে নেমোনের বাবার চাইতে কয়েক বছরের বড়। প্রবীণরা আজও বলে যে নিগ্রো হলেও তরুণী ম’দুজে দেখতে সুশ্রী ছিল, আর কানা-ঘুষায় এও শোনা যায় যে নেনোম তারই মেয়ে।
নেমোনের জন্মের প্রায় এক বছর আগে তার বাবার রাজত্বের দশম বছরে গর্ভাবস্থায় রহস্যজনক পরিস্থিতিতে রানী মারা যায়। মৃত্যুর ঠিক আগে একটি শিশুপুত্র জন্মলাভ করে। তার নাম আলেকস্টার; সে আজও বেঁচে আছে।
তাহলে সে রাজা হল না কেন? টারজান জানতে চাইল।
রাজ-দরবারে ষড়যন্ত্র ও নরহত্যার সে এক দীর্ঘ রহস্যে-ঢাকা কাহিনী; তার কতটা সত্য আর কতটা অনুমান কে জানে। জীবিত লোকদের মধ্যে মাত্র দু’জন সেটা জানে। হয় তো নেমোনও জানে।
রানীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ম’দুজের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। ম’দুজের অনুগ্রহ পেয়ে টমোসের প্রভাব-প্রতিপত্তিও বাড়তে লাগল। বছরখানেক পরে রাজার মৃত্যু হল। তাকে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে এই অভিযোগে সম্ভ্রান্ত লোকরাও বিদ্রোহ করে বসল; কিন্তু মদুজের প্ররোচনায় টমোস সব দোষ আর একটি ক্রীতদাসীর ঘাড়ে চালিয়ে দিয়ে বিদ্রোহীদের শান্ত করল; সেই ক্রীতদাসীর প্রাণদণ্ড দেয়া হল।
শিশু রাজপুত্রের রিজেন্ট হিসেবে টমোস দশ বছর রাজত্ব চালাল। আর আলোকস্টারকে পাগল সাব্যস্ত করে মন্দিরের মধ্যে বন্দী করে রেখে বারো বছর বয়সে নেমোনকে কাথুনির রানীর পদে অভিষিক্ত করা হল।
ওদিকে এরোট হচ্ছে ম’দুজে ও টমোসের সৃষ্টি, আর তার ফলে এমন একটা গোলমেলে ব্যাপারের সৃষ্টি হয়েছে যেটা যেমন মজাদার তেমনই শোচনীয়। টমোস চায় নেমোনকে বিয়ে করতে, অথচ ম’দুজের তাতে মত নেই। তাই ম’দুজে চায় নেমোন এরোটকে বিয়ে করুক, কিন্তু যেহেতু এরোট সিংহ-পুরুষ নয়, এবং যেহেতু রানীর বিয়ে সর্বোচ্চ সম্প্রদায়ে হাওয়াটাই চিরাচরিত প্রথা, তাই নেমোন রানী হিসেবে সে প্রথা ভাঙতে নারাজ।