লঘু পদক্ষেপে একপাশে সরে গিয়ে টারজান তার বাড়ানো হাত দুটি চেপে ধরে দুই দিকে সরিয়ে দিল; তারপরেই একটা ব্রোঞ্জকঠিন হাত ফোবেগের গলাটা চেপে ধরল; পরমুহূর্তেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে টারজান প্রতিপক্ষকে মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল। ফোবেগ সবেগে মল্ল ক্ষেত্রের উপর ছিটকে পড়ল।
নোমোন বাজির আসনে ঝুঁকে বসল; তার চোখ দুটো জ্বলছে; বুকটা উঠছে নামছে। অন্য অনেকের মতই এরোটের বুকটা যেন চেপে বসেছে।
টারজান আবারও ফোবেগের দেহটা মাথার উপর তুলে নিল। অসহায় ফ্লোবেগ বৃথাই হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। টারজান মলু-ক্ষেত্রের এক প্রান্তে রানীর আসনের কাছে পৌঁছে ভারী দেহটাকে জনতার মধ্যে ছুঁড়ে দিল।
বলল, তোমাদের শক্তিমানকে ফিরিয়ে নাও। টারজনের ওকে কোন দরকার নেই।
কী আশ্চর্য, হায়েনার মত চীৎকার করতে করতে জনতা সেই দেহটাকে আবার মলু-ক্ষেত্রের মধ্যেই ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠল, ওকে মেরে ফেল! মেরে ফেল!
আসন থেকে ঝুঁকে নেমোনও চেঁচিয়ে বলল, ওকে মেরে ফেল! মেরে ফেল!
বিরক্তিতে কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে টারজান ফিরে চলল।
টারজান জবাব দিল, আমি ওকে মারব না।
নেমোন উত্তেজনায় লাল হয়ে আসনে উঠে দাঁড়াল। টারজান মুখ তুলতেই বলল, টারজান! কেন তুমি ওকে মারবে না?
টারজান পাল্টা প্রশ্ন করল, কেন মারব? ও তো আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমি হত্যা করি কেবল আত্মরক্ষা বা খাদ্যের জন্য; কিন্তু আমি তো মানুষের মাংস খাই না, কাজেই ওকে মেরে ফেলব কেন?
এরোটের মুখে আতংকের ছায়া। রানীর দিকে তাকিয়ে বলল, এই উদ্ধত বর্বরটাকে শেষ করে দেবার হুকুম কি দেব?
নেমোন মাথা নাড়ল। তার মুখে অজ্ঞাত রহস্যের আবরণ, কিন্তু দুই চোখে এক বিচিত্র অগ্নি জ্বালা। বলল, দু’জনকেই আমরা জীবন ফিরিয়ে দিলাম। ফোবেগকে মুক্ত করে দাও। আর অপরজনকে প্রাসাদে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করে রানী উঠে পড়ল।
সিংহ-ক্ষেত্রের অনেক মাইল দক্ষিণে ওথার উপত্যকার একটি সিংহ তখন অরণ্যের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করে চলেছে। মনে হচ্ছে সে যেন কাকে খুঁজছে। এবার সে মাথা তুলে এমনভাবে গর্জন করে উঠল। যে মাটি কাঁপতে লাগল। আর বানর ‘মানু’ তার ভাই-বোনদের নিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেল। অনেক দূরে একটা হাতি ডেকে উঠল। তারপরেই জঙ্গলের বুকে নেমে এল নিস্তব্ধতা।
একজন আন্ডার অফিসারের নেতৃত্বে একদল সাধারণ সৈনিক টারজানকে সঙ্গে করে স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেখান থেকে সে শহরে ফিরল সম্ভ্রান্ত লোকদের সঙ্গী হয়ে। নেমোনের হাভভাবে তারা। বুঝতে পেরেছিল যে এই নবাগতই হয় তো রানীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠবে; তাই অনেক সম্ভ্রান্ত লোকই তার সঙ্গে মাখামাখি শুরু করে দিল। মলু-ক্ষেত্র থেকেই যারা টারজনের সঙ্গ নিল, নানা ভাবে তারা তার। প্রণস্তিন্ত গাইতে লাগল। গেন তাদের অন্যতম।
শহরে পৌঁছে গেমনন টারজানকে তার নিজের বাসায় নিয়ে তুলল। তার বাসা বলতে একটা শোবার ঘর ও স্নানের ঘর; অন্যসব ব্যবস্থা অপর একজন অফিসারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে চালাতে হয়। দেওয়ালে রয়েছে অস্ত্রশস্ত্র, বর্ম-চর্ম, নানা পশুর মাথা, আর চামড়ার উপর আঁকা ছবি। কিন্তু ঘরের মধ্যে লেখার সরঞ্জাম কিছুই চোখে পড়ল না। গেমননকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে টারজান জানতে পারল, লেখার মত কোন শব্দ কোন লিখিত ভাষায় সে শেখে নি।
স্নান সেরে বেরিয়ে এসেই দেখল আহার প্রস্তুত। টারজান সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসে গেল। গেমনন কাছে বসে কথা বলতে লাগল।
হঠাৎ টারজান প্রশ্ন করল, তোমার সিংহ আছে?
নিশ্চয়। আমি একজন সিংহ পরুষ; সিংহ রাখতেই হবে। রানীর প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে প্রত্যেক সিংহ-পুরুষকে সিংহ রাখতেই হবে। আমার পাঁচটা সিংহ আছে।
সূর্য অস্ত গেলে ঘরে ঢুকল একটি ক্রীতদাস; হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ; সিলিং থেকে ঝোলানো শিকলে প্রদীপটাকে ঝুলিয়ে দিল।
গেমনন দাঁড়িয়ে বলল, সন্ধ্যে ভোজের সময় হয়েছে।
আমি খেয়েছি, টারজান বলল।
তবু চল; সেখানে অনেকের সঙ্গে আলাপ হবে।
টারজান উঠল। গেমননের পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রাজপ্রাসাদ। দু’জন একসঙ্গে সেখানে ঢুকলেও বসবার ঘর থেকেই গেমনন বিদায় নিল। রানীর ঘরে ঢুকল টারজান একা।
দ্রুত চোখ বুলিয়ে টারজান ঘরটা দেখে নিল। ঘরটা বড় নয়, কিন্তু চমৎকারভাবে সাজানো। নিরেট সোনার স্তম্ভের উপর ছাদটা দাঁড়িয়ে আছে। দেওয়ালে হাতির দাঁতের টালি বসানো; রঙিন পাথরে মোজাইক করা মেঝেতে নানা রঙের কম্বল ও জীব-জন্তুর চামড়া ছড়ানো; তার মধ্যে একটি মানুষের মাথাশুদ্ধ ট্যান-করা চামড়াও রয়েছে।
ঘরের এক প্রান্তে একটা বড় সিংহ দুটো স্তম্ভের মাঝখানে শিকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে। সিংহটা প্রকাণ্ড; টারজান ঘরে ঢোকরা মুহূর্ত থেকেই সিংহটা হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরোট ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে না করতেই সিংহটা ভয়ংকর গর্জন করে টারজনের দিকে লাফ দিল। কিন্তু সিংহটা শিকলে বাঁধা; মেঝেতে পড়ে গজরাতে লাগল।
নেমোন বলল, বেলথার তোমাকে পছন্দ করছে না।
ওর মধ্যে তো কাথুনির সব লোকের মনোভাবই প্রতিফলিত হচ্ছে, টারজান জবার দিল।
সেটাই সত্যি নয়, রানী আপত্তি জানাল।