তার কথা শেষ হতেই ঘরের একদিকের দরজা খুলে হাতির দাঁত ও সোনার ঝলমলে পোশাক পরিহিত একটি লোক উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলঃ রানী। বলেই আবার সরে গেল।
সবগুলো চোখ পড়ল দরজার দিকে; সম্ভ্রান্ত লোকগুলো উঠে দাঁড়াল; তারপর দরজার দিকে মুখ করে নতজানু হল। শুধু বানর-রাজ টারজান নতজানু হল না।
জনৈক রক্ষী গর্জন করে উঠল, নিচু হ শেয়াল! পরমুহূর্তেই মৃত্যু-কঠিন নিস্তব্ধতার মধ্যে প্রবেশ করল। রানী। অলসভাবে একবার চারদিকে তাকাল। তার চোখ পড়ল টারজনের উপর। ভুরু দুটি ঈষৎ কুঁচকে গেল।
দীর্ঘ পল্লবে ঢাকা কালো চোখ তুলে রানী টারজনের দিকে তাকাল। দেখল তার ব্রোঞ্জ রঙের চামড়া, আর মাংসপেশী সমৃদ্ধ দেহ। শুধাল, তুমি নতজানু হলে না কেন?
টারজান নির্ভয়ে জবাব দিল, ওরা বলেছে তুমি আমাকে মেরে ফেলবে; তাহলে তোমার সামনে আমি নতজানু হব কেন? তুমি তো আমার রানী নও?
টমোস চীৎকার করে উঠল, থাম! মূর্খ ক্রীতদাস, অসভ্য বর্বর, তুমি কি জান না যে রানী নেমোনের সঙ্গে কথা বলছ?
আন্ডার অফিসারের দিকে মুখ ফিরিয়ে টমোস হুকুম করল, ওদের এখান থেকে নিয়ে যাও; মৃত্যুর ব্যবস্থা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত সেলেই আটকে রাখবে।
নেমোন বলল, দাঁড়াও। এই লোকটি সম্পর্কে আমি আরও কিছু জানতে চাই। টারজনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আদর-ভরা সরল গলায় বলল, তাহলে তুমি আমাকে মেরে ফেলতেই এসেছিলে?
টারজান জবাব দিল, আমি স্ত্রীলোককে মারি না। তোমাকে মারতে আমি এখানে আসি নি।
তাহলে কেন তুমি ওন্থারে এসেছিলে?
টমোসের দিকে মাথাটা নেড়ে টারজান জবাব দিল, ওই লালমুখ বুড়োকে তো সে কথা দু’বার বলেছি। ওকেই জিজ্ঞাসা কর; যারা আমাকে মেরে ফেলাই স্থির করেছে তাদের কাছে আমি আর কৈফিয়ৎ দিতে পারি না।
টারজনের কথায় নেমোনের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সে সংযম হারাল না। ঠাণ্ডা গলায়। শুধাল, অপর লোকটি কে?
এবার জবাব দিল এরোট, ও একজন মন্দির রক্ষী, নাম ফোবেগ। ও দেবতা টুসকে অপবিত্র করেছে।
নেমোন বলল, সিংহ-ক্ষেত্রে ওদের দুজনের লড়াই দেখতে আমাদের বেশ মজাই লাগবে। দেবতা টুস-এর দেয়া দেহ ছাড়া অপর কোন অস্ত্র ছাড়াই ওদের যুদ্ধ করতে হবে। যে জিতবে সে মুক্তি পাবে।
সিংহ-ক্ষেত্র নামে পরিচিত একটা সমতল ভূমিতে বহু দর্শক এসে জমা হয়েছে। রক্ষীরা দুই যোদ্ধাকে সেই দিকে নিয়ে চলল।
সমতল ভূমির মাঝখানে বিশ বা ত্রিশ ফুট মাটি খুঁড়ে নিচে একটা ডিম্বাকৃতি মন্ত্র-ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। সেই মাটি গর্তের চারদিকে ফেলে ক্রমশ উঁচু করা হয়েছে।
খিলানের নিচে দিয়ে মলুক্ষেত্রের দিকে নামবার সময় টারজান দেখল, প্রায় অর্ধেক আসন এর মধ্যেই ভর্তি হয়ে গেছে। নিশ্চয় এটা একটা মহাফুর্তির দিন। সে ফোবেগের কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইল। ফোবেগ বলল, বর্ষাকাল শেষ হলে প্রতি বছরই একটা অনুষ্ঠান হয়; এটা তারই অংশ।
ইতোমধ্যে শহরের দিক থেকে ঢাক ও শিঙার শব্দ ভেসে এল। বাজনা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। কাছে এলে ঢালু জায়গা বেয়ে বাজনাদাররা মল্লাক্ষেত্রের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল।
বাজনার পরেই মার্চ করে এল একদল সৈনিক; প্রত্যেকের বর্শার মাথায় উড়ছে রঙিন পতাকা। দৃশ্য মনোরম, কিন্তু এর পরে যা, এল তার তুলনায় কিছুই নয়।
সৈনিকদের কয়েক গজ পিছনেই এল চার সিংহে টানা সোনার রথ; তার উপরে লোম ও বিচিত্র রঙের কাপড়ে সাজানো আসনে অর্ধশায়িত ভঙ্গিতে বসে আছে রানী নেমোন। ষোলটি কালো ক্রীতদাস ধরে আছে সিংহের রাশ; রথের দুই পাশে মার্চ করে চলেছে সোনা ও হাতির দাঁতের ঝকঝকে পোশাক পরা দু’জন করে সম্ভ্রান্ত লোক; দীর্ঘদেহী একটি কালো মানুষ একটা বড় লাল ছাতা ধরে আছে রানীর মাথায়।
শোভাযাত্রা মলু-ক্ষেত্রে পৌঁছবার পরে নেমোন রথ থেকে নেমে সমবেত সকলের জয়ধ্বনির মধ্যে তার নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসল।
বেজে উঠল শিঙা। সৈনিকরা টারজান ও ফোবেগকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্র-ক্ষেত্রের চারদিকে ঘুরতে লাগল। রানীর আসনের সামনে দিয়ে যাবার সময় নেমোন আধ-বোজা চোখে নবাগত লোকটিকে ও মোটা কাথুনীয়কে ভাল করে লক্ষ্য করল।
ক্যাপ্টেন ঘোষণা করল, শিঙা বাজলেই তোমরা লড়াই শুরু করতে পার। দেবতা টুস্ তোমাদের সহায় হোন।
শিঙা বেজে উঠল। সারা রঙ্গালয় উৎকণ্ঠায় নিশ্চুপ। দু’জন এগিয়ে গেল ‘দু’জনের দিকে। ফোবেগ গর্বোদ্ধত, আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ়। টারজনের গতি সিংহের মত সহজ, সাবলীল।
ফোবেগ টারজনের একেবারে কাছে এগিয়ে গেল। টারজান গলাটা বাড়িয়ে দিল। ফোবেগ সেটা চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে টারজান দুই হাতের মুঠো এক করে হঠাৎ সেটাকে তুলে সজোরে আঘাত করল ফোবেগের থুতনিতে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঠেলে দিল। ফোবেগের ভারী দেহটা সবেগে ছিটকে গেল ডজন। খানেক পা দূরে; সে ধপাস করে বসে পড়ল।
হতভম্ব জনতার মুখ থেকে একটা সবিস্ময় আর্তনাদ বেরিয়ে এল। যারা টারজনের উপর বাজি ধরেছিল তারা সোল্লাসে চীৎকার করে উঠল। ( ফোবেগ কোনরকমে উঠে দাঁড়াল। তীব্র ক্রোধে মুখখানা লাল। গর্জে উঠে সে আবার টারজানকে আক্রমণ করল, আর রেহাই নেই। এবার তোকে শেষ করব।
মৃত্যু! মৃত্যু! ফোবেগের সমর্থকরা চেঁচাতে লাগল। মৃত্যু! মৃত্যু! আমরা চাই মৃত্যু!