একটু একটু করে সে নিজের দেহটাকে টেনে তুলল নদীর তীরে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল; সিংহের মত শরীরটাকে একবার ঝেড়ে নিল; ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে একটা অস্পষ্ট আলোর রেখা যেন চোখে পড়ল। টারজান সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলল।
নদী থেকে কয়েক পা এগোতেই সামনে একটা প্রাচীর। প্রাচীরের কাছাকাছি হতেই আলোটা আর চোখে পড়ল না। কয়েক পা পিছিয়ে এক দৌড়ে প্রাচীরের কাছে গিয়ে দিল লাফ। বাড়ানো আঙুল দিয়ে প্রাচীরের মাথাটা ধরে ঝুলে পড়ল। ধীরে ধীরে উপরে উঠে ঘোড়ার মত প্রাচীরের দুই পাশে পা ঝুলিয়ে বসে প্রাচীরের অপর পারে তাকাল।
আলোর দিকে অর্ধেক পথ পৌঁছনো মাত্রই অবসিত প্রায় ঝড়ের শেষ বিদ্যুৎটি ঝলসে উঠল। টারজনের সামনে দেখা দিল একটা নিচু বাড়ি, একটা আলোকিত জানালা, একটা ঢাকা-দেয়া দরজা ও তার আশ্রয়ে দণ্ডায়মান একটি মানুষ। সেই ক্ষণিক আলোয় টারজানও সেই মানুষটির দৃষ্টিকে এড়াতে পারল না।
সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টার কর্কশ শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। দরজাটা সপাটে খুলে গেল, বাইরে বেরিয়ে এল মশালধারী অনেক মানুষ। পশুর স্বাভাবিক সতর্কতা বশেই টারজান উল্টোদিকে। ছুট দিল; টারজান বুঝতে পারল, পালাবার চেষ্টা বৃথা। দুই হাত বুকের উপর ভাঁজ করে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তিন দিক থেকে লোকজন এসে তাকে ঘিরে ধরল। সে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে নিশ্চয় এটা স্বর্ণ-শহর।
টারজান বন্দী হল স্বর্ণ-শহরের রক্ষীদের হাতে। রক্ষীরা চত্তর পেরিয়ে একটা বাড়িতে টারজানকে নিয়ে গেল। মশালের আলোয় যে ঘরে তাকে ঢুকিয়ে দিল সেখানে আরও একটি লোককে সে দেখতে পেল।
ঘর অন্ধকার। টারজান সঙ্গীকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
তবু সময় নষ্ট না করে টারজান তখনই ঘরটি পরীক্ষা করতে শুরু করল। প্রথমেই গেল দরজার কাছে। সেখান থেকে দেয়াল বরাবর ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। সে জানে, ঘরের অপর লোকটি দূর কোণে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে।
অন্ধকারে কে যেন বলে উঠল, কি করছ?
ঘরটা পরীক্ষা করছি-টারজান বলল।
লোকটি বলল, আমার নাম ফোবেগ। তোমার?
টারজান।
তুমি কি কাথুনির লোক, না এথনির?
কোনটাই না; আমি এসেছি সুদূর দক্ষিণের একটা দেশ থেকে।
এই কাথুনিতে এলে কেমন করে?
পথ হারিয়ে এসে পড়েছি, পুরো সত্য কথাটা টারজান বলতে চাইল না; শুধু বলল, বন্যার তোড়ে ভাসতে ভাসতে তোমাদের শহরে এসে পড়েছি। এখানে ওরা আমাকে বন্দী করেছে; ওদের অভিযোগ, আমি ওদের রানীকে হত্যা করতে এসেছি।
অর্থাৎ ওদের ধারণা তুমি নেমোনকে হত্যা করতে এসেছ! কি জান, যে কোন অবস্থাতেই নেমোনকে খুশি করতে ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।
নেমোন কি তোমাদের রানী?
ফোবেগ আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, ঈশ্বরের কেশরের নামে বলছি, সে রানী তো বটেই, তার চাইতেও অনেক কিছু বেশি! ওন্থার বা থেনারে আগে কখনও এমন রানী হয় নি, আর ভবিষ্যতেও কখনও হবে না।
রানী কি সুন্দরী? টারজান প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, আমাদের রানী পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। কিন্তু এবার ফোবেগ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, কিন্তু সে একটি শয়তানী। আমি যে এত বছর ধরে তার সেবা করছি আমিও তার কাছে করুণা ভিক্ষা করতে চাই না।
টারজান শুধাল, কোন্ অপরাধে তুমি এখানে এসেছ?
ফোবেগ বিষণ্ণ গলায় বলল, ভুলক্রমে আমি ঈশ্বরের লেজে পা দিয়েছিলাম।
লোকটির কথা শুনেই টারজনের খটকা লেগেছিল, কিন্তু এই শেষের কথা শুনে সে হতভম্ব হয়ে গেল।
টারজান লোকটির ভাষা বুঝতে পারলেও তার কথার তাৎপর্য কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। রানীর খুশির সঙ্গে ন্যায়বিচারের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
সে যখন এই সব চিন্তা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল, ঠিক সেই সময় বহুদূর দক্ষিণে আর একটি বন্য প্রাণী ঝড়ের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছে। তারপর দিনের আলো ফুটলে সে বাইরের রোদে বেরিয়ে এল। বন্য প্রাণীটি আর কেউ নয়-আমাদের পূর্ব পরিচিত কালো কেশরওয়ালা সেই সিংহটি। নতুন-ওঠা রোদে হলদে সবুজ চোখ দুটো মিটমিট করতে করতে প্রাতঃরাশের খোঁজে নিচে নেমে গেল। আবার ঠিক সেই সময়ই দুটি সৈনিকের সঙ্গে একজন কালো ক্রীতদাস জঙ্গলে রাজার জন্য প্রাতরাশ নিয়ে কাথুনির কারা-কক্ষে প্রবেশ করল।
বিনা প্রতিবাদে কাথুনির কারা কক্ষে ঢুকবার সময় টারজান ভেবেছিল যে পরদিন সকালেই তাকে জিজ্ঞবাদ করে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু পরদিন সকালে ওরা তাকে বাইরে নিয়ে যায় নি; তারপর দিনও নয়, এবং তার পরের দিনও নয়। সেও মুক্তির আশায় আশায় অপেক্ষা করেই আছে।
তারপর একদিন চারজন সৈনিক এসে দরজাটা সপাটে খুলে ফেলল। তাদের একজন হাঁক দিল, আমাদের সঙ্গে চলে এস-দু’জনই।
ফোবেগ বিষণ্ণ মনে, আর টারজান নুমার মত আরণ্য মর্যাদার সঙ্গে তাদের পিছু পিছু চলতে লাগল। চত্ত্বর পেরিয়ে একটা দরজার ভিতর দিয়ে দীর্ঘ বারান্দার শেষে একটা বড় ঘরে সকলে ঢুকল। সেখানে হস্তিদন্ত ও স্বর্ণখচিত পোশাকে সজ্জিত সাতজন অফিসার একটা টেবিলের উপরে বসে ছিল। তাদের মধ্যে দু’জনকে টারজান চিনতে পারল-প্রবীণ টমোস ও তরুণ গেমনন।
ফোবেগ ফিসফিস করে বলল, এরা সকলেই সম্ভ্রান্ত লোক। টেবিলের ঠিক মাঝখানে বসেছে বুড়ো চমোস, রানীর মন্ত্রী; তার ডাইনে বসেছে এরোট; সে আমার মত সাধারণ সৈনিকই ছিল, কিন্তু নেমোনের নজর পড়ায় সে এখন রানীর প্রিয় পাত্র। তার বাঁ দিকে বসে আছে যুবক গেমনন। তার অধীনে যে সব সৈনিক কাজ করে তারা সকলেই বলে তার মত লোক হয় না।