তাঁবুর ভিতরকার কাণ্ড দেখে কোল্ট তো একেবারে হা–দুটি নর-নারী মেঝেতে পড়ে ধস্তাধস্তি করছে; পুরুষটি মেয়েটির গলা টিপে ধরেছে, আর মেয়েটি প্রাণপণে পুরুষটির মুখে কিল-গুতো মারছে।
কোল্ট জাফরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক ঝটকায় তাকে এক পাশে ঠেলে ফেলে দিল। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জাফরও এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুবকটিকে আক্রমণ করতেই সে তাকে এমন এক ঘুষি চালাল যে জাফরের মাথাটা ঘুরে গেল। আবার আক্রমণ করতেই আর এক ঘুষি পড়ল তার মুখে। এবার জাফর মাটিতে পড়ে গেল। কোন রকমে উঠে দাঁড়াতেই কোল্ট তাকে সজোরে চেপে ধরে একপাক ঘুরিয়ে পাছায় লাথি মেরে তাবুর দরজা দিয়ে বাইরে ঠেলে দিল। ফিলিপিনো সঙ্গীকে বলল, ও যদি আবার তাঁবুতে ঢুকতে চেষ্টা করে তো গুলি করবে টনি। তারপর মেয়েটিকে তুলে নিয়ে খাটিয়ায় শুইয়ে দিয়ে কোল্ট বালতি থেকে জল এনে জোরার কপাল, গলা ও কব্জি ভাল করে মুছে দিল।
বাইরের গাছের ছায়ায় কুলি ও আস্কারিদের শুয়ে থাকতে দেখে রঘুনাথ জাফর গুটি গুটি নিজের তাঁবুর দিকে সরে পড়ল। তার বুকের মধ্যে ক্রোধ ও খুনের নেশা টগবগ করে ফুটছে।
জোরা ড্রিনভ চোখ মেলে তাকাল। তার মুখের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েনি কোল্ট।
কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে জোরা ড্রিনভ বলল, নিশ্চয় তুমিই সেই মার্কিন যুবক।
কোল্ট জবাব দিল, আমি ওয়েনি কোল্ট। আর তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ বলেই অনুমান করছি যে এটা কমরেড জাভেরির শিবির।
মেয়েটি মাথা নাড়ল। তুমি ঠিক সময়েই এসে পড়েছিলে কমরেড।
সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।
একটু পরে কোল্ট শুধাল, কমরেড জাভেরি কি শিবিরে নেই?
না; সে একটা ছোট অভিযানে বেরিয়েছে।
কোল্ট হেসে বলল, তাহলে তো আমাদের দু’জনকে পরিচয় করিয়ে দেবার মত কেউ এখানে নেই।
জোরা বলল, আমি ক্ষমা চাইছি। আমার নাম জোরা ড্রিনভ।
আর ও লোকটা কে?
রঘুনাথ জাফর, একজন হিন্দু।
ও কি আমাদের লোক?
হা; কিন্তু আর থাকবে না- পিটার জাভেরি ফিরে আসার পরে তো নয়ই।
তার মানে?
মানে পিটার ওকে খুন করবে।
কোল্ট কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সেটাই ওর প্রাপ্য। হয়তো সে প্রাপ্যটা আমারই মিটিয়ে দেয়া উচিত ছিল।
মার্কিন যুবকটি তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। চোখ দুটো অর্ধেক বুজে জোরা খাটিয়াতেই শুয়ে রইল।
গাছের উপর বসে টারজান সবই লক্ষ্য করছে। অপরিচিত যুবকটি ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ তার মনকে টেনেছে। ওদিকে রঘুনাথ জাফর যে একটা রাইফেল হাতে নিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল সেটাও তার দৃষ্টি এড়ায়নি।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে জাফর সোজা জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। টারজানও গাছের উপর দিয়ে তার পিছু নিল। জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে শিবিরের অর্ধেকটা ঘুরে জাফর থেমে গেল। সেখান থেকে গোটা শিবিরটাই সে অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু পাতার আড়ালের জন্য তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
কোল্ট লোকজনের কাজকর্মের তদারক করছে। পথশ্রমে ক্লান্ত লোকগুলো চুপচাপ কাজ করে চলেছে। চারদিকে শান্ত নিস্তব্ধতা। হঠাৎ একটা আর্ত চীৎকার ও রাইফেলের গুলির শব্দ শুনে সে স্তব্ধতা খান্ খান্ হয়ে গেল। একটা বুলেট কোল্টের মাথার পাশ দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে পিছনে দাঁড়ানো লোকটির কানের নতি ছিঁড়ে দিয়ে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হৈ-চৈ পড়ে গেল। কোন দিক থেকে গুলিটা এসেছে খুঁজতে গিয়েই কোল্টের চোখে পড়ল জঙ্গলের ভিতর থেকে এক ঝলক ধোঁয়া উঠছে।
ঐ তো ওখানে, বলে কোল্ট সেদিকেই ছুটে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে আস্কারিদের সর্দারকে বলল, কিছু লোক সঙ্গে নিয়ে তুমি ডান দিক থেকে এগিয়ে যাও, আর বাকিদের নিয়ে এগোচ্ছি বাঁদিক থেকে।
ঠিক আছে বাওয়ানা, বলে সর্দার কিছু লোক নিয়ে এগিয়ে গেল।
কোল্টই প্রথম দেখতে পেল-শিবিরের কাছাকাছি পড়ে আছে রঘুনাথ জাফরের মৃতদেহ। তার ডান হাতে রাইফেলটা ধরাই আছে, বুকের উপর থেকে বেরিয়ে আছে একটা তীরের কাঠি।
হিন্দুটিকে কবর দেবার নির্দেশ দিয়ে ওয়েনি কোল্ট লোকজন নিয়ে তাঁবুতে ফিরে এল।
জোরা ড্রিনভ তার তাঁবুর দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কি? কি হয়েছে?
রঘুনাথ জাফর খুন হয়েছে।
সব বিবরণ শুনে জোরা বলল, তাহলে তীরটা কে ছুঁড়ল?
কোল্ট বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সবই যেন রহস্যে ঢাকা।
খাবার টেবিলে বসে কোল্ট বলল, আজ তোমার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে, অথচ তোমার তো কোনরকম ভাবান্তর দেখছি না।
জীবনে এ রকম অনেক ঝড় আমি কাটিয়ে এসেছি কমরেড কোল্ট, কাজেই আমার মধ্যে এখন স্নায়ু বলতে কিছু নেই।
কোল্ট এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, তোমাকে দেখে মনে হয় জন্মসূত্রে তুমি প্রোলেতারিয়েত নও।
আমার বাবা ছিল শ্রমিক। জারের আমলে নির্বাসনে থাকতেই তার মৃত্যু হয়। তাই তো যা কিছু রাজকীয়, যা কিছু পুঁজিবাদ সংক্রান্ত সে সবেতেই আমার এত ঘৃণা। তাই তো কমরেড জাভেরির দলে যোগ দেবার প্রস্তাব যখন এল তখন প্রতিশোধ নেয়ার আর একটা ক্ষেত্র আমি খুঁজে পেলাম।
কোল্ট বলল, যুক্তরাষ্ট্রে জাভেরির সঙ্গে যখন আমার সর্বশেষ দেখা হয় তখন তার মাথায় এখনকার মত কোন পরিকল্পনা নিশ্চয় ছিল না, কারণ এ ধরনের কোন অভিযানের কথা সে তখন আমাকে বলেনি। এখানে এসে তার সঙ্গে যোগ দেবার নির্দেশ যখন পেলাম তখনও বিস্তারিত বিবরণ কিছুই আমাকে জানানো হয়নি। কাজেই তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমি এখন সম্পূর্ণ অন্ধকারেই আছি।