কিটেম্বো সব সাদা মানুষকেই ঘৃণা করে। স্মরণাতীতকাল থেকে ব্রিটিশরা এসে তাদের দেশকে অধিকার করেছে।
কিটেম্বো সর্দার অসভ্য, নিষ্ঠুর, বিশ্বাস হন্তা; তার কাছে সব সাদা মানুষই অভিশাপস্বরূপ। তবু জাভেরির সঙ্গে যোগাযোগটাকে সে ব্রিটিশদের উপর প্রতিশোধ নেবার একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাই সে তার স্বজাতিদের অনেককে এনে জাভেরির অভিযানে নাম লিখিয়েছে, কারণ জাভেরি। তাকে কথা দিয়েছে ব্রিটিশদের চিরদিনের মত এখান থেকে তাড়িয়ে দেবে এবং আবার কিটেম্বোকে সগৌরবে তার আসনে বসাবে।
আজকের এই মনোরম সকালে এমনি একটি দলই যাত্রা করেছে রহস্যময় ওপার-এর রত্ন- ভাণ্ডার লুট করার আশায়।
জোরা ড্রিনভ তাদের যাত্রার পথের দিকেই তাকিয়ে আছে। যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ জোরার দুটি সুন্দর চোখের তারা স্থিরনিবদ্ধ হয়ে রইল পিটার জাভেরির উপর। ধীরে ধীরে নদীর পথটা ধরে চলতে চলতে সে অন্ধকার বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
জাভেরি দলবল নিয়ে চলেছে ওপার-এর পথে। ষড়যন্ত্রকারীদের মূল দলটার সঙ্গে তাড়াতাড়ি মিলিত হবার আশায় ওয়েনি কোল্ট তার লোকজনদের তাড়া দিচ্ছে দ্রুততর গতিতে অগ্রসর হতে। পাছে অধিক সংখ্যায় এক সঙ্গে আফ্রিকায় ঢুকলে সকলের মনোযোগ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাই প্রধান ষড়যন্ত্রকারীরা। ভিন্ন ভিন্ন পথে আফ্রিকায় ঢুকেছে। কোল্ট নেমেছে পশ্চিম উপকূলে। সেখান থেকে কিছুটা পথ ট্রেনে গিয়ে তারপর চলেছে পব্রজে। স্বভাবতই অন্য প্রধান ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে মিলিত হতে সে খুবই ইচ্ছুক হয়ে পড়েছে। কারণ একমাত্র পিটার জাভেরি ছাড়া আর কারও সঙ্গে তার পরিচয় নেই।
ইউরোপের শান্তিকে বিঘ্নিত করা এবং উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তার করাই যাদের লক্ষ্য সে রকম একটি অভিযাত্রী দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার মধ্যে যে প্রচণ্ড বিপদের ঝুঁকি আছে মার্কিন যুবকটি তা ভাল করেই জানে। তবু যৌবনের উৎসাহ দমিয়ে রাখতে পারেনি।
উপকূল থেকে একঘেয়ে দীর্ঘ যাত্রাপথে তার একমাত্র সঙ্গী ছেলে মানুষ টনি। ফিলিপিনের স্বাধীনতা সম্পর্কে তার ধারণা খুবই অস্পষ্ট। অর্থনৈতিক বিপ্লবের ফলে একদিন না একদিন ফোর্ড বা রকফেলারের সম্পত্তির অংশীদার হয়ে সেও ভাল ভাল পোশাকপত্র কিনতে পারবে এই স্বপ্নেই সে বিভোর।
কোল্টরা চলেছে তো চলেছে। তারা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নি যে তাদের মাথার উপরকার বৃক্ষ-পথে চলেছে এক অরণ্য-দেবতা এপোলো, আর তার কাঁধে বসে অবিরাম কিচিরমিচির করছে একটা ছোট বানর। গাছের উপর দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ-ই এই সাদা মানুষটি টারজনের চোখে পড়ে যায়। তখনই তার মনে হয়, যে নবাগত মানুষদের মূল শিবিরের খোঁজে সে চলেছে এই যুবকটিও হয়তো সেই দিকেই যাচ্ছে; আর তাই ধৈর্যের সঙ্গে সে এই যুবকটিকে অনুসরণ করে চলেছে।
ওদিকে রঘুনাথ জাফর চলেছে জোরা ড্রিনভের তাঁবুর দিকে। মেয়েটি খাটিয়ায় শুয়ে বই পড়ছিল। জাফর দরজায় দাঁড়াতেই তার ছায়া পড়ল বইটার উপর। মেয়েটি চোখ তুলে তাকাল।
হিন্দুটির ঠোঁটে খোসামোদের হাসি। বলল, দেখতে এলাম তোমার মাথার ব্যথাটা কেমন আছে।
মেয়েটি ঠাণ্ডা গলায় বলল, ধন্যবাদ। কিন্তু কেউ আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত না ঘটালেই আমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাব।
তবু জাফর ভিতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসল। বলল, সকলেই চলে যাওয়ায় বড় একা-একা লাগছে।
না। আমি একাই ভাল আছি। বিশ্রাম নিচ্ছি।
জাফর বলল, তোমার মাথা ব্যথাটা বড় তাড়াতাড়ি চাড়া দিয়ে উঠল। একটু আগেও তো তোমাকে বেশ তাজা ও হাসিখুশি দেখেছিলাম।
মেয়েটি কোন জবাব দিল না।
সম্ভবত তার মনের কথাটা আঁচ করেই রঘুনাথ জাফর বলল, ওয়ামালা আস্কারিদের সঙ্গে শিকারে গেছে।
আমি তো তাকে অনুমতি দেইনি, জোরা বলল।
অনুমতিটা আমিই দিয়েছি, জাফর বলল।
খাটিয়ায় উঠে বসে মেয়েটি সক্রোধে বলল, সে অধিকার তোমার নেই। তুমি বড় বেশি দূর এগিয়েছ। কমরেড জাফর।
হিন্দুটি সান্ত্বনার ভঙ্গীতে বলল, একটু অপেক্ষা কর লক্ষ্মীটি। ঝগড়া করো না। তুমি তো জান আমি তোমাকে ভালবাসি, আর ভিড়ের মধ্যে ভালবাসা জমে না।
মেয়েটি বলল, বটে, এতদূর! জাভেরি ফিরে আসুক, তারপর এর ফয়সালা হবে।
হিন্দুটি সাগ্রহে বলল, জাভেরি ফিরে আসার অনেক আগেই আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব কেমন করে আমাকে ভালবাসতে হয়। বলেই সে পা বাড়াল। মেয়েটিও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রের খোঁজে চারদিকে তাকাল।
হিন্দুটি বলল, তুমি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। তাঁবুতে ঢুকেই আমি সব কিছু দেখে নিয়েছি।
তুমি একটা পশু, জোরা বলল।
কেন এত অবুঝ হচ্ছ জোরা? ভেবে দেখ
বেরিয়ে যাও! মেয়েটি আদেশ করল।
কিন্তু রঘুনাথ জাফর দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরল।
ওয়েনি কোল্টের গাইড কিছুটা আগে আগেই চলছিল। হঠাৎ থেমে মুখটা হাসিতে ভরিয়ে সে পিছন ফিরে তাকাল। সামনে আঙুল বাড়িয়ে বিজয়গর্বে বলল, ঐ শিবির বাওয়ানা!
সেই রকমই দেখাচ্ছে। কোল্ট ঘাড় নাড়ল। চারদিকে ঘুরে একটু দেখাই যাক। টনিকে সঙ্গে নিয়ে কোল্ট তাঁবুগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।
সঙ্গে সঙ্গে তার নজরে পড়ল, একটা তাঁবুর মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছে।