মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জাভেরি হিংস্র চোখে চারদিক তাকাতে তাকাতে বলল, কে? কে আমাকে গুলি করল?
আমি, জোরা ড্রিনভ বলল।
তুমি! জাভেরি ঢোক গিলল।
হঠাৎ ওয়েনি কোল্টের দিকে ফিরে জোরা বলতে লাগল, সব কথা তোমার জানা দরকার। আমি কম্যুনিস্ট নই, কোনো দিন ছিলাম না। এই লোকটা আমার বাবাকে, মাকে আর দাদা ও দিদিকে খুন করেছে। আমার বাবা ছিল–কিন্তু সে কথা থাক। এতদিনে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলাম। তীব্র দৃষ্টিতে জাভেরির দিকে তাকিয়ে বলল, গত কয়েক বছরে অনেকবারই তোমাকে মারতে পারতম, কিন্তু মারিনি। কারণ তোমার জীবনের চাইতেও বেশি কিছু আমি চেয়েছিলাম। গোটা বিশ্বের সুখ-শান্তিকে ধ্বংস করার যে জঘন্য পরিকল্পনা তুমি এবং তোমার মত লোকেরা করেছিল, আমি চেয়েছিলাম সেটাকে ব্যর্থ করার কাজে সাহায্য করতে।
পিটার জাভেরি উঠে বসল। বিস্ফারিত চোখ দুটি চকচক করছে। হঠাৎ সে খক- খক্ করে কাসল। মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠতে লাগল। তার পরই সে ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
খোলা জায়গাটার ওপারে জঙ্গলের প্রান্তে এসে দাঁড়াল একটি মূর্তি। নিঃশব্দে সে যেন আকাশ থেকে মেনে এসেছে। জোরা ড্রিনভই তাকে প্রথম দেখতে পেল। চিতার চামড়ার লেংটি-পরা একটি সাদা মানুষ এগিয়ে আসছে। তার চলনে সিংহের সাবলীল গতি-ভঙ্গী।
ও কে? কোল্ট প্রশ্ন করল।
জোরা বলল, কে তা জানি না, তবে এটুকু জানি যে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেললে সেই আমার প্রাণরক্ষা করেছিল।
লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল।
কে তুমি? ওয়েনি কোল্ট শুধাল।
আমি অরণ্যরাজ টারজান। এখানে যা কিছু ঘটেছে সব আমি দেখেছি, শুনেছি। জাভেরির মৃতদেহ দেখিয়ে বলল, ওই লোকটা যে মতলব কেঁদেছিল তা ভেস্তে গেছে, সেও মারা গেছে। এই মেয়েটি নিজেই বলেছে সে তোমাদের কেউ নয়। একে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব; যে যাতে সভ্য জগতে ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করব। তোমরা আর যারা আছ তাদের জন্য আমার কোন সহানুভূতি নেই। তোমরা জঙ্গল থেকে চলে যেতে পার। আমার কথা শেষ।
কিন্তু এই মার্কিন ভদ্রলোক ওদের সঙ্গে যাবে না, জোরা বলল।
যাবে না? কেন? টারজান জানতে চাইল।
কারণ সে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন স্পেশ্যাল এজেন্ট।
সকলেই সবিস্ময়ে জোরার দিকে তাকাল।
কোল্ট বলল, এ কথা তুমি কেমন করে জানলে?
শিবিরে এসে প্রথম যে চিঠিটা তুমি পাঠিয়েছিলে সেটা জাভেরির একজন লোকের হাতে পড়েছিল। এখন বুঝতে পারলে?
হা।
সেই জন্যই জাভেরি তোমাকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে খুন করতে চেয়েছিল।
কালা আদমিরা এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। তাদের ভাষায় টারজান বলল, তোমাদের দেশ আমি চিনি। উপকূলে যাবার রেল পথের শেষে সে দেশ অবস্থিত।
তাদের একজন বলল, ঠিক বলেছ হুজুর।
রেলপথের শেষ পর্যন্ত এই সাদা মানুষটিকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও। আর খাবার ব্যবস্থা করে দিও। আর কোন রকম ক্ষতি করো না। তারপর তোমাদের দেশ থেকে তাকে চলে যেতে বলল। তারপর সাদা মানুষদের দিকে ফিরে বলল, আপাতত তোমরা আমার সঙ্গে শিবিরেই চুল।
সকলে ফিরে চলল। অন্যদের থেকে একটু পিছিয়ে পড়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল জোরা ড্রিনভ ও ওয়েনি কোল্ট।
জোরা বলল, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি মরে গেছ।
আমি তো ভাবছিলাম তুমি মরে গেছ, কোল্ট বলল।
জোরা আবার বলল, আর সবচাইতে দুঃসংবাদ কি জান, জীবিত বা মৃত কোন অবস্থাতেই আমার মনের কথাটি তোমাকে বলতে পারব না।
কোল্ট নিচু গলায় বলল, আর আমি ভেবেছিলাম, তোমার-আমার মধ্যে যে ব্যবধান তার একটা সেতু গড়ে তুলতে যে প্রশ্নটা তোমাকে করতে চাই তা কোন দিন করা হবে না।
জোরা ঘুরে দাঁড়াল। দুই চোখ জলে ভরা। ঠোঁট কাঁপছে। বলল, আর আমি ভাবছিলাম, জীবিত বা মৃত কোন অবস্থাতেই তোমার সে প্রশ্নের জবাবে কোন দিন হ্যাঁ বলতে পারব না।
একটা বাঁক ঘুরে তারা সকলের দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল।
চিতা-মানুষের দেশে চারজন (টারজান এণ্ড দি লিওপার্ড মেন)
মেয়েটি অস্বস্তির সঙ্গে বিছানায় পাশ ফিরল। বাতাসের বেগে পেট-মোটা মাছিগুলো সশব্দে তাঁবুর চাদোয়ার উপর আছড়ে পড়ছে। খোটায় টান লেগে তাঁবুর দড়িগুলো কডুকডু শব্দ করছে। খোলা পর্দাগুলো বাতাসে উড়ছে। তবু ঘুমন্ত মানুষটি পুরো জাগল না। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ভাপসা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একঘেঁয়ে দীর্ঘ পদযাত্রায় সে ক্লান্ত। শুধু একদিন তো নয়, অনেক দূর অতীতে যেদিন সে রেলের পথ ছেড়ে এসেছে তারপর থেকেই চলেছে এই একটানা পথ চলা।
না জানি কি অনিবার্য প্রয়োজন তাকে এই পথে নিয়ে এসেছে! বিলাস ও স্বাচ্ছন্দ্যের পথ ছেড়ে কোন্ প্রয়োজনে সে এসেছে এই আদিম অরণ্যে; বিপদ, রোদ-বৃষ্টি ও ক্লান্তির এই অনভ্যস্ত জীবনে? কেন সে এসেছে?
এই প্রচণ্ড ঝড়ের রাতে একটিমাত্র আস্কারি প্রহরী ঘুম-ঘুম চোখে জেগে আছে। দুটি প্রাণী ছাড়া তাঁবুর অন্য সকলেই ঘুমিয়ে আছে। বিশাল বপু আদিবাসীটি চুপি চুপি এগিয়ে চলেছে ঘুমন্ত মেয়েটির তাঁবুর দিকে।
মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেল, একটা লোক তাঁবুতে ঢুকল। সর্দার গোলাটোর বিশাল দেহকে চিনতে তার ভুল হল না। কনুইতে ভর দিয়ে পাশ ফিরে প্রশ্ন করল, কিছু কি গোলমাল হয়েছে গোলাটো? কি চাও তুমি?
লোকটি চাপা গলায় জবাব দিল, তোমাকে চাই কালি বাওয়ানা।