পরদিন সকালে পাঁচ শ্বেতমূর্তি ফিরে চলল তাদের মূল শিবিরে।
আর ঠিক একদিনের পথ আগে থেকে অন্য এক সোজা পথে টারজান ও তার ওয়াজিরি সেনারা চলল। ওপার-এর দিকে।
টারজান মুভিরোকে বলল, লা হয়তো সেখানে নেই। কিন্তু ওআ ও ডুথকে আমি শান্তি দিতে চাই যাতে লা বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন ওপার-এ ফিরে গিয়ে প্রধান সন্যাসিণীর গদিতে বসতে পারে।
বহু মাইল দূরে তাদের এই বন্ধুটি জঙ্গলের মধ্যে একটা ভোলা জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। এক সময় সেখানে একটা বড় শিবির ছিল; এখন কয়েকটা ঝুপড়িতে কিছু কালা আদমি থাকে।
তার পাশাপাশি হাঁটছে ওয়েনি কোল্ট। এতদিনে সে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। তাদের পিছনে চলেছে সোনালী সিংহ জান্-বা-জা।
কোল্ট বলল, শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম। তোমাকে ধন্যবাদ।
লা বলল, ভালই হল। এবার তোমার কাছ থেকে বিদায় নেব। তার গলায় বেদনার সুর।
কোল্ট বলল, বিদায় কথাটা আমার ভাল লাগে না।
একটি নারী ও একটি পশু পাশাপাশি চলে গেল ওপার-এর পথে। সেদিকে তাকিয়ে কোল্টের গলায় কি যেন আটকে আসতে লাগল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে শিবিরে ফিরে গেল। কালো মানুষগুলো দুপুরের রোদেও ঘুমিয়ে আছে। তাদের ডেকে তুলল। কোল্টকে দেখে তারা তো হতবাক। তারা যে ধরেই নিয়েছিল সে মারা গেছে।
ওপার-এর প্রান্তরে বিধ্বস্ত নগরীর দিকে হাঁটছে একজন নারী ও একটা সিংহ। তাদের পিছনে খাড়ির। উঁচু মাথায় দাঁড়িয়ে তাদের দিকেই লক্ষ্য রেখেছে আর একজন মানুষ। তার পিছনে একশ’ সৈনিক পাহাড়ের উত্রাই বেয়ে উপরে উঠছে। তারা এসে পাশে দাঁড়াতেই দীর্ঘদেহ মানুষটি আঙ্গুল বাড়িয়ে বলল, লা!
আর নুমাও, মুভিরো বলল। সে পিছন পিছন হাঁটছে কী আশ্চর্য বাওয়ানা, সে কিন্তু আক্রমণ করছে না।
টারজান বলল, আক্রমণ করবে না। ও যে জাবাল-জা।
পিছনের হৈ-চৈ-এর শব্দ প্রথমে জাদু-বাল-জার কানেই ধরা পড়ল। থেমে সে মুখ ফেরাল। মাথাটা তুলল। কান খাড়া করল। নাক কুঁচকাল। তারপরই গাঁ-গাঁ করে ডেকে উঠল। লা দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল। একটি অগ্রসরমান সেনাদলকে দেখে সে হতাশায় ভেঙে পড়ল।
দলটা এগিয়েই আসছে। হঠাৎ লা-র নজরে এল, যে লোকটি সকলের আগে আগে আসছে তার গায়ের রং ফর্সা। সে চিনতে পেরেছে। চীৎকার কলে বলল, ওই তো টারজান! জান্-বা-জা, ওই তো টারজান।
হয়তো জাদ-বাল-জাও মনিবকে চিনতে পারল। একছুটে এগিয়ে গেল। টারজনের সামনে গিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তার কাঁধে দুই থাবা রেখে আদর করে গালটা চাটতে লাগল। তাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে টারজান লা-র দিকে এগিয়ে গেল।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত
লা বলল, হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত তুমি শিকার করে ফিরে এলে।
টারজান বলল, আমি তখনই ফিরেছিলাম, কিন্তু তুমিই চলে গিয়েছিলে।
তুমি ফিরে এসেছিলে? তা যদি জানতাম তাহলে তো আমি অনন্তকাল সেখানেই অপেক্ষা করে থাকতাম।
টারজান সস্নেহে লা-র কাঁধে হাত রাখল। অস্ফুট স্বরে বলল, সেই চিরকালের লা! তারপরই কি যেন মনে পড়তে ওপার-এর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, চল। রানী এবার ফিরে যাবে তার সিংহাসনে।
ওপার-এর অদৃশ্য চোখগুলো অগ্রসরমান দলটিকে দেখতে পেল। লা, টারজান ও ওয়াজিরিদের তারা চিনতে পারল। অনেকে জান্-বা-জাকেও চিনল। ওআ ভয় পেল। ডুথ কাঁপতে লাগল। ছোট নাও এর বুক খুশিতে ভরে উঠল।
অভিযাত্রীরা বহিঃপ্রাচীরের প্রাঙ্গণে ঢুকল। একটি প্রাণীও তাদের বাধা দিল না। দরবার-কক্ষে ঢুকে যে দৃশ্য তাদের চোখে পড়ল তাতেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। রক্তাল্পত অবস্থায় পড়ে আছে ওআ ও ডুথ-এর মৃতদেহ; পাশেই ছ’টি সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীর মৃতদেহ। আর কেউ কোথাও নেই।
অগ্নি-দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনী লা আর একবার ওপার-এর রানী হয়ে সিংহাসনে বসল।
সেদিন রাতে অরণ্যরাজ টারজান ওপার-এর সোনার থালায় আহার্য গ্রহণ করল। সুন্দরী তরুণীরা। পরিবেশন করল মাংস, ফল ও অমৃতস্বাদ দ্রাক্ষারস।
পরদিন সকালে অরণ্যরাজ ফিরে চলল দলবল নিয়ে। তার কাঁধের উপর ছোট্ট নকিমা, পাশে সোনালী সিংহ, আর পিছনে একশ’ ওয়াজিরি সৈন্য।
দীর্ঘ একঘেয়ে পথ চলার পর সাদা মানুষদের ক্লান্ত অবসন্ন দলটা তাদের মূল শিবিরে ফিরে এল। সকলের আগেই জাভেরি ও আইভিচ, তাদের পিছনে জোরা ড্রিনভ, বেশ কিছুটা দূরে পাশাপাশি রোমেরা ও মোরি। এই ভাবেই দীর্ঘ পথ তারা পার হয়ে এসেছে।
তাদের আসতে দেখে কোল্ট এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যেন জ্বলে উঠল জাভেরি। চীৎকার করে বলল, বিশ্বাসঘাতক! তোমাকে শেষ করাই আমার জীবনের শেষ কাজ। রিভলবার বের করে নিরস্ত্র কোল্টকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল।
প্রথম গুলিটা কোল্টের গা ঘেসড়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু দ্বিতীয়বার গুলি করার সময় আর জাভেরি পেল না। তার পিছন থেকে গর্জে উঠল আর একটা আগ্নেয়াস্ত্র। পিটার জাভেরির হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেল। এক হাতে পিঠ চেপে ধরে সে মাতালের মত টলতে লাগল।
আইভিচ বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াল। হা ভগবান, এ তুমি কী করলে জোরা?
জোরা বলল, যা করতে বারো বছর অপেক্ষা করেছিলাম। শৈশব পার হবার পর থেকেই যে কাজটি করার জন্য বেঁচে আছি।
ওয়েনি কোল্ট ছুটে গিয়ে জাভেরির রিভলবারটা মাটি থেকে তুলে নিল। ততক্ষণে রোমেরো ও মোরিও ছুটে এসেছে।