যে কোন সম্রাট বা দেবতার সামনে তারা সকলেই নতজানু হল; যারা কাছে ছিল তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে তার হাত-পা স্পর্শ করল। ওয়াজিরিদের কাছে টারজান তো শুধু রাজা নয়, সে যে তাদের জীবন্ত দেবতা।
টারজান বলল, খুব ভাল কাজ করেছ বাছারা। নকিমাও ঠিক মতই কাজটা করেছে। আমার চিঠিটা তোমাদের পৌঁছে দিয়েছে, আর যেখানে তোমাদের দেখা পাব বলে ভেবেছিলাম ঠিক সেখানেই তোমাদের পেয়ে গেলাম।
মুভিরো বলল, সব সময় আমরা নবাগতদের চাইতে একদিনের পথ এগিয়ে থাকি বাওয়ানা। শিবির। ফেলি ওদের পথ থেকে বেশ কিছুটা দূরে, যাতে আমাদের শিবির ওদের চোখে না পড়ে।
টারজান বলল, আগামীকাল আমরা এখানেই তাদের জন্য অপেক্ষা করব। আজ রাতে টারজান তোমাদের বুঝিয়ে বলবে তার পরিকল্পনার কথা।
পরদিন সকালে জাভেরির দলবল আবার যাত্রা শুরু করল। ঘণ্টাখানেক নির্বিঘ্নে কেটে গেল। হঠাৎ মাথার উপর থেকে একটি ভৌতিক কণ্ঠস্বর। বান্টু ভাষায় ঘোষণা করলঃ মুলুব, সন্তানরা, ফিরে যাও। যদি বাঁচতে চাও তো ফিরে যাও। আর বিলম্ব না করে সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর।
জাভেরি বলল, ওটা কে? কি বলল?
আমাদের সতর্ক করে দিয়ে ফিরে যেতে বলল, কিটেম্বো জবাব দিল।
জাভেরি চমকে উঠল, ফেরা হবে না। যাই ঘটুক, আমরা এগিয়ে যাবই।
বিষণ্ণ মনে সকলে যার যার জায়গায় থেকে চলতে লাগল। সামনে অনেক দূর থেকে ভেসে এল সেই ভৌতিক কণ্ঠস্বর; সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর।
জাভেরি ও জোরা ড্রিনভ পাশাপাশি হাঁটছিল। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে বলল, ওই লোকটাকে যদি হাতের কাছে পেতাম তো এক গুলিতে
তার কথা শেষ হবার আগেই দলের পিছন দিকে আকাশ থেকে ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর ও সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর।
ইতোমধ্যে গোটা দল জঙ্গল পার হয়ে একটা খোলা জায়গায় পড়েছে। সেখানে তারা মাথা-সমান উঁচু ঘাসের ভিতর দিয়ে চলতে লাগল। মাঝামাঝি পৌঁছবার পরেই গর্জে উঠল একটা রাইফেল। আর একটা। আরও একটা।
গুলি কারও গায়ে লাগে নি। তবু সেনাদলের মধ্যে হৈ-চৈ পড়ে গেল। দেখা দিল বিশৃংখলা।
আবার সামনে শোনা গেল সেই সতর্কবাণীঃ ফিরে যাও! এই শেষ সতক-বাণী। অমান্য করলে মৃত্যু অনিবার্য।
দলে ভাঙন দেখা দিল। রোমেরো গুলি করার হুকুম দিল। প্রত্যুত্তরে সামনের ঘাসের ভিতর থেকে গুলি চলল। এবার ডজনখানেক লোক পড়ে গেল– কেউ নিহত, কেউ আহত হল।
জাভেরির দলবল অনেক কষ্টে তাদের শেষ শিবিরে পৌঁছে গেল। কিন্তু রাত পর্যন্ত হিসেব করে দেখা গেল শতকরা পঁচিশজন তখনও নিখোঁজ; তাদের মধ্যে জোরা ও রোমেরোও আছে। একে একে যারাই শিবিরে এল তাদের প্রত্যেককে জাভেরি মেয়েটির কথা জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কেউ তাকে দেখেনি।
আরও একটু রাত হতেই দু’জন একসঙ্গে শিবিরে ঢুকল। তাদের দেখে জাভেরি যেমন স্বস্তি বোধ করল, তেমনি রাগও হল।
ধমক দিয়ে বলল, তোমরা আমার সঙ্গে থাকলে না কেন?
কারণ আমি তোমার মত ছুটতে পারি না, জোরা জবাব দিল। জাভেরি আর কিছুই বলল না।
শিবিরের উপরকার অন্ধকারের ভিতর থেকে ভেসে এল সেই পরিচিত সতর্কবাণী ও সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর! তারপর দীর্ঘ নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে কালা আদমিদের ফিসফিস্ আলোচনা। আবার সেই কণ্ঠস্বর ও তোমাদের দেশে ফিরে যাবার পথ সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত, কিন্তু সাদা মানুষদের পিছনে হাঁটছে মৃত্যু। তোমাদের উর্দি ছুঁড়ে ফেলে দাও; সাদা মানুষদের ছেড়ে দাও জঙ্গলে ও আমার হাতে।
একটি কালা সৈনিক শরীর থেকে ফরাসী উর্দি খুলে ফেলে উনুনের আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও তাই করতে লাগল।
থাম! জাভেরি চীৎকার করে বলল।
চুপ কর সাদা মানুষ! পাল্টা গর্জে উঠল কিটেম্বো।
সাদাদের মেরে ফেল! জনৈক বাসেম্বো সৈনিক চীৎকার করে বলল।
সবাই ছুটল সাদা মানুষদের লক্ষ্য করে। উপর থেকে আবার ভেসে এল সতর্কবাণী ও সাদা মানুষরা আমার লোক। তাদের আমার হাতেই ছেড়ে দাও।
সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকরা থেমে গেল। জাভেরি রাগে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। সব্বাইকে গালাগালি করে বলল, আমাকে কেউ সাহায্য করলে এ রকমটা ঘটত না। কিন্তু আমি একা তো সব কাজে করতে পারি না।
এ কাজটা তো তুমি একাই করেছ, রোমেরো বলল।
কি বলতে চাও তুমি?
আমি বলতে চাই, একটা উদ্ধত গাধার মত কাজ করে তুমি সব্বাইকে শক্ত করে তুলেছ। তবু তোমার সাহসের উপর ভরসা থাকলে তারা তোমার সঙ্গেই চলত। একটা ভীরুকে অনুসরণ করতে কেউ চায় না।
তোমার এতদূর স্পর্ধা! চীৎকার করে উঠে জাভেরি রিভলবারে হাত দিল।
জোরা বলে উঠল, এ সব কি পাগলামি হচ্ছে। একদল উচ্ছল কালা আদমির মধ্যে আমরা মাত্র পাঁচজন। কাল তারাও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমরা যদি প্রাণ নিয়ে আফ্রিকা থেকে ফিরে যেতে চাই তাহলে আমাদের একসঙ্গে চলতে হবে। নিজেদের ঝগড়া ভুলে যাও; সকলের মুক্তির জন্য একযোগে কাজ কর।
বাকি রাতটা সুখে না হোক নির্বিঘ্নেই কাটল। সকালে দেখা গেল, সব কালা আদমি গা থেকে ফরাসী উর্দি খুলে ফেলেছে। পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য একজনের সহাস্য চোখেও সে দৃশ্য দেখল। কোন কালো ছোকরা সাদা মানুষদের সেবা করতে এল না। তারা নিজেরাই প্রাতরাশ তৈরি করল।
কালা আদমিরা যার যার গাঠরি কাঁধে ফেলে শিবির থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করল। তাদের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে সাদা মানুষগুলো চুপচাপ বসে রইল।