বড় বড় গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে সে চলতে লাগল। আপন খেয়াল খুশিতে একবার এদিকে ছোটে, একবার ওদিকে। আর তাতেই অনেক সময় নষ্ট হল।
এইভাবে নকিমা যখন বহুদূর জঙ্গলে অকারণে ছুটাছুটি করছে, ঠিক তখনই পাঁচ মিনিট পরে ডরস্কি আবার ঢুকল টারজনের তাবুতে। নিজস্ব মতলবটাকে মনে মনে ঠিক করে নিয়েই সে এসেছে।
বন্দীর মুখের ভাব বদলে গেছে। কান পেতে কি যেন শুনছে। ডরস্কিও কান পাতল। কিন্তু কিছুই শুনতে পেল না। টারজনের অন্তর কিন্তু খুশিতে ভরে উঠেছে।
ডরস্কি বলল, আমি এসেছি তোমাকে শেষ সুযোগ দিতে। ওপার-এর স্বর্ণ-ভাণ্ডারের সন্ধানে কমরেড জাভেরি দু’বার সেখানে অভিযান চালিয়েছে; দু’বারই ব্যর্থ হয়েছে। সকলেই জানে, ওপার-এর রত্ন ভাণ্ডার কোথায় আছে তা তুমি জান এবং আমাদের সেখানে নিয়ে যেতেও পার। কথা দাও, কমরেড জাভেরি ফিরে এলেই তুমি এ কাজ করবে, তাহলে তোমার কোনরকম ক্ষতি করা তো হবেই না, উপরন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে। আমার প্রস্তাব না মানলে তুমি মরবে। কোমরের খাপ। থেকে লম্বা ছুরিটা টেনে বের করল।’
টারজান তবু পাথরের মত নিপ। ছুরির সরু ফলাটা তার চোখের সামনে এনে ডক্তি বলল, বেশ ভাল করে ভেবে দেখ। মনে রেখো, এই ফলাটা যখন তোমার পাঁজরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেব তখন একটুও : শব্দ হবে না। ফলাটা তোমার হৃৎপিণ্ডে ঢুকে যাবে, আর রক্ত বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। তারপর ফলাটা বের করে ঘাটা জুড়ে দেব। বিকেলের দিকে দেখা যাবে তুমি মরে পড়ে আছ, আর নিগ্রোদের কাছে আমি জানাব যে হঠাৎ গুলি লেগে তুমি মারা গেছ। সত্য ঘটনা তোমার বন্ধুরা জানতেও পারবে না। তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধও কেউ নেবে না। বৃথাই তোমার জীবনটা যাবে।
ছুরিটা টারজনের মুখের একেবারে কাছে এসে গেছে। হঠাৎ বন্য পশুর মত টারজানও গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ইস্পাতের কঠিন চোয়াল দিয়ে চেপে ধরল ডবৃস্কির কব্জি। সে ছিটকে সরে গেল। অবশ আঙ্গুলের ভিতর থেকে ছুরিটা মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টারজান তার আততায়ীকে লেঙ্গি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার পিঠের উপর চেপে বসল।
চীৎকার করে লোকজনদের ডাকতে ডাকতে ডরস্কি বাঁ হাত দিয়ে কোমরের রিভলবারটা বের করতে চেষ্টা করল, কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারল যে দেহের উপর থেকে টারজানকে সরাতে না পারলে সে কাজ করা যাবে না।
তার কানে এল, লোকজন সব হৈ-হৈ করে ছুটে আসছে। তারপরেই শুনতে পেল আতংকের চীৎকার। আর পরমুহূর্তেই মাথার উপর থেকে তাঁবুটা অদৃশ্য হয়ে গেল; ডরস্কি সভয়ে দেখতে পেল একটা প্রকাণ্ড হাতি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
মুহূর্তের মধ্যে ডরস্কিকে ছেড়ে দিয়ে টারজান পাশ ফিরে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডরস্কিও রিভলবারে হাত দিল। টারজান চীৎকার করে বলল, মার ট্যান্টর, মার।
হাতির ঝোলানো শুড়টা এসে ডবৃস্কিকে পেঁচিয়ে ধরল। কর্কশ গলায় চীৎকার করতে করতে ডরস্কিকে মাথার উপর তুলে কয়েক পাক ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিল শিবিরের মধ্যে। আতংকিত নিগ্রোরা ছুটে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। ট্যান্টর এগিয়ে গিয়ে দাঁত দিয়ে ডরস্কির দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এমনভাবে তাকে পায়ের নিচে পিষতে লাগল যে মাইকেল ডরস্কি একটা রক্তাক্ত পিণ্ডে পরিণত হল।
ধীরে ধীরে সে শান্ত হল। হেলে দুলে টারজনের পাশে এসে দাঁড়াল। তার কথামত টারজানকে পিঠের উপর তুলে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল।
গভীর বনে ঢুকে ট্যান্টর নরম ঘাসের উপর টারজানকে শুইয়ে দিল।
সেই সময় গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে ছোট্ট নকিমাও সেখানে এসে উপস্থিত হল।
তাকে দেখে টারজান বলল, নিচে নেমে এস নকিমা; আমার হাতের বেড়ি খুলে দাও।
নকিমা ছোট ছোট দাঁত দিয়ে চামড়ার বেড়ি কেটে দিল। এবার সে নিজের পায়ের বেড়ি কেটে ফেলল।
এবার ট্যান্টর টারজানকে পিঠে তুলে নিল। নকিমাও মনিবের দেখাদেখি লাফিয়ে উঠল প্রথমে ট্যান্ট বের পিঠে, তারপর সেখান থেকে টারজনের কাঁধে।
তিন বন্ধু নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। গাছের ছায়া দীর্ঘতর হতে লাগল। বনের আড়ালে সূর্য অস্ত গেল।
এইভাবে দিন কাটে। অসহায় কোল্ট শয্যাশায়ী। জাভেরি এগিয়ে চলেছে ইতালীয় সোমালিল্যান্ডের দিকে। মাথার ক্ষত সেরে যাওয়ায় টারজান চলেছে তাদেরই পথ ধরে।
এক সময় জাভেরির অগ্রগামী বাহিনীকে সে ধরে ফেলল। তখন রাত। শ্রান্ত লোকজনরা শিবিরে বসে আমোদ-ফুর্তি করছে। ব্যাপারটা যে জানে না তার মনে হবে এটা বুঝি ফরাসী উপনিবেশ রক্ষীবাহিনীর শিবির।
গাছের উপর বসে টারজান সবই দেখল। ধনুকে একটা তীর জুড়ল। ছিলায় টংকার দিয়ে তীরটা ছুঁড়ে দিল। সেটা গিয়ে বিধল একটি শাস্ত্রীর পায়ের গুলিতে। বিস্ময়ে ও বেদনায় চীৎকার করে সে মাটিতে পড়ে গেল। লোকজন এসে তাকে ঘিরে দাঁড়াল। সেই ফাঁকে টারজান জঙ্গলের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
ওদিকে আর একটা সেনাদলও চলেছে সেই জঙ্গলের পথ ধরে। সারাদিন হেঁটে রাতে তাদের অস্থায়ী শিবির পড়ল। আহারাদি শেষ করে শ’খানেক কালো সৈনিক ধুনির চারপাশে ইতস্তত শুয়ে বসে গল্প শুরু করল।
এমন সময় মাথার উপরকার গাছের ডাল থেকে একটি মূর্তি এসে নামল তাদের ঠিক মাঝখানে।
সঙ্গে সঙ্গে একশ’ সৈনিক লাফ দিয়ে অস্ত্র হাতে নিল; কিন্তু পরমুহূর্তেই সহজভাবে থেমে গিয়ে গলা ছেড়ে বলে উঠল, বাওয়ানা! বাওয়ানা।