একদিকে সমস্ত শিবির জুড়ে যখন চলেছে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ কর্মব্যস্ততা, তখন ওদিকে একশ’ কাল সৈনিক এগিয়ে আসছে জঙ্গলের পথে। তাদের গায়ের চামড়া মসৃণ, চকচকে; তাদের ঘুমন্ত মাংসপেশী ও সহজ পদক্ষেপ তাদের দৈহিক সক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করছে। গোড়ালিতে ও কব্জিতে তামার বালা, গলায় সিংহ বা চিতার নখের মালা, এবং সিংহ বা চিতার চামড়ার এক ফালি কটি-বস্ত্র ছাড়া নগ্ন দেহ। প্রত্যেকের মাথায় সাদা পাখির পালক গোঁজা। কিন্তু তাদের আদিম সাজ-সজ্জার এখানেই ইতি, কারণ তাদের সকলেরই হাতে আধুনিক অস্ত্রের সম্ভার; স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রিভলবার ও বুলেট ভর্তি চামড়ার বক্ষবন্ধনী। একটি দুর্ভেদ্য বাহিনী নিঃশব্দে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে জঙ্গলের ভিতরে দিয়ে। তাদের দলপতির কাঁধের উপর বসে আছে একটা ছোট্ট বানর।
নদী তীরের অস্থায়ী শিবির থেকেই সুযোগমত আলাদা আলাদা ভাবে জোরা ড্রিনভ ও ওপায়ের লা আবু বতনের হাত থেকে পালিয়ে গেল। ঘটনাচক্রে এক সময় আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে গেল। পথশ্রমে ক্লান্ত ওয়েনি কোল্ট ও লার সঙ্গে। ঠিক এই ভাবে একদিন জঙ্গলের মধ্যে জোরা’ড্রিনভের দেখা হয়ে গেল টারজনের সঙ্গে। দু’জন এক সঙ্গে চলতে লাগল। আর সেই অবস্থাতেই একদিন এক গুপ্ত আততায়ীর গুলিতে আহত হল টারজান। ফলে তারা দুজনেই ধরা পড়র জাভেরির দলের হাতে।
পরদিন খুব সকালে অভিযাত্রী দল সারি বেঁধে শিবির থেকে বেরিয়ে পড়ল। কালা আদমিরা গায়ে চড়িয়েছে ফরাসী উপনিবেশরক্ষী বাহিনীর উর্দি জাভেরি, রোমেরো, আইভিচ ও মোরির গায়ে ফরাসী অফিসারদের পোশাক। টারজনের সেবাশুশ্রূষার জন্য জোরা ড্রিন থেকে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু জাভেরির হুকুমে তাকেও দলের সঙ্গে চলতে হচ্ছে। বন্দীর দেখাশুনা এবং রেখে যাওয়া রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র পাহারা দেবার জন্য অল্প কয়েকটি নিগ্রো ও ডরস্কিকে শিবিরে রেখে যাওয়া হয়েছে।
যাত্রার ঠিক পূর্বক্ষণে জাভেরি চুপিচুপি শেষ নির্দেশ শুনিয়ে দিল ডবৃস্কিকে। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তোমার হাতেই ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি। এমন ব্যবস্থা করবে যাতে মনে হবে যে সে পালিয়েছে অথবা কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে।
ডরস্কি বলল, এ নিয়ে তোমাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না কমরেড। তুমি ফিরে আসার অনেক আগেই বাছাধনকে ভবপারে পাঠিয়ে দেব।
আক্রমণকারীদের সামনে কষ্টকর দীর্ঘপথ। পাঁচশ মাইল বন্ধুর পথে দক্ষিণ-পূর্ব আবিসিনিয়ার ভিতর দিয়ে তাদের ঢুকতে হবে ইতালীয় সোমালিল্যান্ডে। জাভেরির মনোগত বাসনা ইতালীয় উপনিবেশে আক্রমণের একটা মহড়া শুধু দেবে। তাতেই ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইতালীয়দের ক্রোধ জাগ্রত হবে, আর সেখানকার ফ্যাসিস্ত ডিক্টেটর সেই ওজুহাতে ইউরোপের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
জাভেরি হয়তো কিছুটা পাগল ছিল। এতদিন সে দেখেছে একটি সাম্রাজ্যের স্বপ্ন; এখন দেখছে দুটি সাম্রাজের স্বপ্ন। এক নতুন রোমক সম্রাট শাসন করবে ইউরোপ, আর সে নিজে হবে আফ্রিকার সম্রাট। তার চোখের সামনে ভাসছে দুই সোনার সিংহাসন–একটিতে আসীন সম্রাট প্রথম পিটার, আর অপরটিতে সাম্রাজ্ঞী জোরা। অভিযানের দীর্ঘ পথ এই স্বপ্ন দেখেই সে কাটাতে লাগল।
সকালে টারজনের জ্ঞান ফিরল। শরীর দুর্বল, রুগ্ন; মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা। নড়বার চেষ্টা করতেই বুঝল, হাত-পা শক্ত করে বাঁধা। কি ঘটেছে, কোথায় আছে–কিছুই সে জানে না। তাঁবুর ক্যানভাসের দেয়ালে দেখে বুঝল, যে ভাবেই হোক শত্রুর হাতে সে ধরা পড়েছে। এখানে সে একা নয়; বাইরে লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছে। তবে যতদূর মনে হয়, তারা সংখ্যায় বেশি নয়।
গভীর জঙ্গল থেকে ভেসে এল হাতির ডাক। অস্পষ্টভাবে কানে এল সিংহের গর্জন। মাথাটা ঘুরিয়ে তাঁবুর বাইরে তাকাল। তার ঠোঁট থেকে বের হল একটানা নিচু চীৎকার- বিপন্ন পশুর বুকফাটা ডাক।
ডরস্কি তার তাঁবুর সামনে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছিল। লাফ দিয়ে উর্ধ্বে দাঁড়াল।
ছোকরা নিগ্রো-চাকরটাকে সঙ্গে নিয়ে ভয়ে ভয়ে টারজনের তাঁবুর দিকে এগোতে লাগল। ডরস্কির হাতে উদ্যত রিভলবার।
ঘরে ঢুকে দেখল, টারজান যেখানে ছিল সেখানেই শুয়ে আছে। তবে তার চোখ দুটি খোলা। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সে ডরস্কির দিকে তাকাল। ডরস্কি কয়েকটা প্রশ্ন করল, কোন জবাব পেল না।
ডরস্কির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। চীৎকার করে বলল, বাঁটা গোরিলা, আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করো না। আমি ভাল করেই জানি, এ লোকটার বকবকানি সব তুমি বুঝতে পেরেছ। তাছাড়া, তুমি একজন ইংরেজ, অবশ্যই ইংরেজি জান। তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে গেলাম। ফিরে এসেও যদি দেখি তুমি কথা বলছ না, তাহলে তোমার কপালে অশেষ দুর্গতি আছে। বলেই সে তাঁবু থেকে সটান বেরিয়ে গেল।
ছোট্ট নকিমা অনেক পথ পার হয়ে গিয়েছিল। তার গলার শক্ত বেড়ি থেকে ঝুলছিল একটা চামড়ার থলে। তার মধ্যেই চিঠিটা ছিল। সেটা সে এনে দিয়েছিল ওয়াজিরিদের সেনাপতি মুভিরোকে। আর ওয়াজিরিরা যখন পথে নামল তখন নকিমা সগর্বে মুভিরোর কাঁধেই বসে পড়ল। অনেকটা সময় পর্যন্ত সে মুভিরোর কাঁধেই ছিল; তারপর মনের খেয়ালই হোক আর অন্য কোন প্ররোচনাতেই হোক সকলকে ছেড়ে সে নিজের কাজে চলে গেল।