সেই রাত্রে বার্ককে আর্মটঙ্গের বাড়িতে রেখে ডক্টর ডেভিস একটা লণ্ঠন নিয়ে সেই পুরোনো শবঘরে গিয়েছিলেন। মাটিতে পড়ে থেকে বিক্ষিপ্ত ইটের টুকরোগুলো তখনও চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছিল। চন্দ্রকিরণে স্নাত বড় দরজার হুড়কোটা সামান্য নেমে এসেছে। ওটাকে বাইরে থেকে একটু ঠেললেই খুলে যাবে। এত দিন ব্যবচ্ছেদ ঘরে থেকে থেকে বিভিন্ন বিষয়ে যে ডাক্তারের মনটা পোক্ত হয়ে উঠছে তা বোঝাই যাচ্ছিল। তিনি লণ্ঠনটা উঁচু করে ধরে শবঘরের মধ্যে ঢুকলেন। ঘরের ভেতরের অবস্থা দেখে ডাক্তারের মাথা ঘুরে গেল। তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন। পরক্ষণেই তাঁর ভয়ানক আঁতকে-ওঠাটা একটু আগের চিৎকারটাকেও পেছনে ফেলে দিল। তিনি একদৌড়ে ফিরে এলেন আর্মটঙ্গের বাড়িতে। ডাক্তারির সমস্ত নিয়ম ভেঙে তিনি চিৎকার করে রোগীকে ডেকে তুলেই ক্ষান্ত হলেন না, অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে রোগীকে ধরে ঝাঁকাতেও লাগলেন। অবশ্য তিনি ফিশফিশ করেই কথা বলছিলেন, কিন্তু উত্তেজনায় সেই শব্দগুলো শিসের মতো গিয়ে কানে বিঁধছিল।
ওটা আসাফের কফিন। বার্ক। আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। ওর দাঁতগুলো আমি দেখেছি। ওপরের চোয়ালের সামনের পাটির একটা দাঁত ভাঙা। শুধু তা-ই না। তোমার এই ক্ষতই প্রমাণ করে দিচ্ছে যে আমি ভুল নই। তার দেহটা মোটামুটি নষ্টই হয়ে গেছে, কিন্তু তার মুখে যে আক্রোশ দেখে এলাম তা আগে কখনও দেখিনি। তুমি তো জানোই, কীরকম পাষণ্ড প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল আসাফ সইয়ার। সেই জমির সীমানা নির্দেশের গোলমালে ত্রিশ বছর পরে এসেও সে বুড়ো রেমন্ডকে প্রায় শেষ করে ফেলছিল। এক বছর আগে আঁচড়ে দেওয়ার প্রতিশোধ তোলার জন্যে সে গত অগাস্টে বাচ্চা কুকুরটাকে মাড়িয়ে মেরে ফেলছিল। শয়তানের অবতার ছিল সে… বার্ক। আমি মনে করি, তার চোখের বদলে চোখ প্রতিশোধের ব্যাপারে সে হয়তো যমকেও ছাড়িয়ে যাবে। কী ভয়ংকর ওই রাগ! ভগবান! আমার ওপরে যেন তা কোনও দিন না এসে পড়ে। বার্ক, তুমি কেন এটা করলে? জানি, সে এক নম্বরের বজ্জাত ছিল। আমি তোমাকে কোনও দোষ দিচ্ছি না ওকে একটা পরিত্যক্ত কফিনে ঢুকিয়েছ বলে। কিন্তু তুমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছ। কৃপণতা করা ঠিক আছে, কিন্তু তুমি তো জানতে, ফেনার কতটা বেঁটেখাটো ছিল। হে ভগবান, কেন দেখতে গেলাম? দৃশ্যটা ভুলব কী করে এখন আমি! তুমি একটু বেশি জোরেই লাথি মেরেছিলে। আসাফের কফিনটা পড়ে ছিল মাটির ওপরে। মাথাটা ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে, পচা ঘিলুও বেরিয়ে এসেছে। এসব আমি আগেও দেখেছি, কিন্তু এখানে আরও কিছু ছিল। খুলিটা দেখে আমার বমি পেয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তুমি যা করেছ… চোখের বদলে চোখ। মা মেরির দিব্যি! বার্ক, কিন্তু তুমি তোমার প্রাপ্যই পেয়েছ। কী করে করতে পারলে ওটা? ওই ছোট কফিনটার মধ্যে ওই লম্বা দেহটাকে খুঁজেছ তুমি আসাফের পা দুটো গোড়ালি থেকে কেটে!?
[প্রথম প্রকাশ: ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে টাই-আউট নামে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্পটি। ভাষান্তর : অঙ্কিতা]
সারমেয় সংকেত
সারমেয় সংকেত (THE HOUND)
[ উইয়ার্ড টেলস পত্রিকায় প্রকাশিত লাভক্র্যাফটের প্রথম গল্পে আবদুল আলহাজেডের নেক্রোনমিকনের প্রথম উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেও লাভক্র্যাফট গল্পটি সুইসাইড নোটের আকারে লিখেছেন। গল্পটি পো, অ্যামব্রোস বিয়ার্স ও কার্ল হায়েসম্যানের লেখা থেকে প্রভাবিত বলে মনে করা হয়।]
বিরামহীন সাঁইসাঁই শব্দে অস্থির হয়ে উঠেছে কান, যেন কোনও দুঃস্বপ্নের দেশে ডানা ঝাপটাচ্ছে কিছু। দূরে কোথাও একটানা ডেকে চলেছে কোনও অতিকায় হাউন্ড, মৃদু আওয়াজ আসছে তারও। পাগল হয়ে যাচ্ছি কিংবা স্বপ্ন দেখছি ভেবে নিজের মনকে হয়তো ভোলাতে পারতাম। কিন্তু একের পর এক যা ঘটে গেছে, তাতে আর ওইসব আত্মপ্রবঞ্চনা করে লাভ নেই। কীসের কবলে পড়ে সেন্ট জনের শরীরটা একটা ছেঁড়াখোঁড়া লাশ হয়ে গেল, তার রহস্য জানি কেবল আমি। আমারও ওই একই পরিণতি হওয়ার আগে গুলি করে নিজের মাথা উড়িয়ে দিতে চলেছি আমি। কারণ এই মুহূর্তে কোনও এক অশুভ এলড্রিচ জগতের অন্ধকার অন্তহীন সুড়ঙ্গপথ বেয়ে সবেগে ধেয়ে আসছে আমার মৃত্যুদূত। তারই আতঙ্কে বেছে নিয়েছি আত্মহননের পথ।
এক মূর্খ বিকারের জেরে নেমে এসেছে এই ঘোর বিপর্যয়। রোজের সাদামাটা জীবনটায় আর তৃপ্তি হচ্ছিল না আমাদের। ফিকে হয়ে আসছিল প্রেম আর অ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণও। অবসাদের থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছিলাম আমি আর সেন্ট জন। তাই যেখানে যা নান্দনিক ঘরানা কিংবা শিল্পশৈলী আছে, মিলে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছিলাম তাদের রহস্য উদ্ধারে। পেরিয়েছিলাম প্রতীকীবাদীদের প্রহেলিকা আর প্রাক্-রাফেলীয়দের উচ্ছ্বাসের শিল্পরুচির পথ। হাজির হয়েছিলাম ব্যভিচার-বাদীদের নিরানন্দ চারুকলায়। সে শিল্পের বাইরের অংশটুকুতে মন ভরেনি আমাদের। পরিতৃপ্তির সন্ধানে ডুব দিয়েছিলাম তার নারকীয় গভীরতায়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সেখানেও মন টেকেনি আমাদের। অচিরেই ঘুচে গিয়েছিল বোদলেয়র আর হাইসমান্সের সৃষ্টির প্রতি আকর্ষণও।
অবশেষে আরও উত্তেজনা খোঁজার তাগিদে শুরু হল আর-এক প্রয়াস। সশরীরে অপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা ভোগের প্রচেষ্টা। আর এই অদম্য বাসনার তাড়নায় আমরা হাত লাগালাম এক জঘন্য অপকর্মে। তার কথা বলতে এই আতঙ্কের মধ্যেও আমার মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে আসছে।