অজ্ঞান হওয়ার আগেই বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তিতে তার দেহ এক ঝাঁকুনিতে উঠে এল গর্তটার কাছে। পরক্ষণেই প্রায় অচেতনের মতোই গর্তের মধ্যে গলিয়ে দিল নিজের দেহ। সামান্য হামাগুড়ি দিতেই গর্তের অন্য পাশ দিয়ে ধপ করে বার্ক উলটে পড়ল ভেজা মাটির ওপরে। সে বুঝতে পারছিল যে, সে হাঁটতে পারছিল না। উদীয়মান চাঁদটা একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিল সেই ভয়ংকর ঘটনার। সে কোনওমতে রক্তাক্ত পা টানতে টানতে এগিয়ে যেতে লাগল কবরস্থানের কাছের বাড়িটার দিকে। কোনওমতে কালো মাটি আঁকড়ে ধরে প্রায় অচৈতন্যের মতোই এগিয়ে যাচ্ছিল। ক্রমশ তার গতি কমে আসছে। শরীর আর সঙ্গ দিচ্ছে না। ঠিক যেমন রাত্রে অমানুষদের তাড়া খেলে ভয়ে দেহ অবশ হয়ে আসে। আসলে তার পেছনে কেউই দৌড়ে আসছিল না। একাকী হামাগুড়ি দিতে দিতে ভয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় সে কোনওমতে পৌঁছোল বাড়িটায়। আর্মিংটন, বাড়ির মালিক তার দুর্বল আঁচড়ানির শব্দেই দরজা খুলে দিয়েছিল।
আর্মিংটন বার্ককে ধরাধরি করে বসার ঘরের অতিরিক্ত বিছানাটায় শুইয়ে দিল। তৎক্ষণাৎ তার ছোটছেলে এডউইনকে পাঠাল ডক্টর ডেভিসকে ডেকে আনার জন্য। আর্ত মানুষটি অবশ্য স্বজ্ঞানে ছিল, কিন্তু তার মুখ থেকে কোনওরকম শব্দ বেরোচ্ছিল না। সে শুধু অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করছিল, উফ। গোড়ালিটা… ছাড় আমাকে। হতচ্ছাড়া! পচে মর তুই নরকে।
অনতিবিলম্বেই ডাক্তার ওষুধের বাক্স নিয়ে এলেন। দু-চার কথাতে জেনে নিলেন, কী ঘটেছে। রোগীর ভিজে-যাওয়া জামাকাপড়, জুতো-মোজা ডাক্তার নিজের হাতেই খুলে নিলেন। দুই পায়ের গোড়ালির সামান্য ওপরে বীভৎস ক্ষতস্থান। পায়ের অ্যাকিলিস টেন্ডনটা (রগ) প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় পরিণত হয়েছে। আঘাতের বহর দেখে বৃদ্ধ ডাক্তারও হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁকে সামান্য ভীতও দেখতে লাগছিল। ডাক্তারি শাস্ত্র ছেড়ে তাঁর প্রশ্নগুলো বিশ্রীভাবে অন্যদিকে বাঁক নিচ্ছিল। এমনকী তাঁর হাত পর্যন্ত কাঁপছিল, যখন তিনি পায়ের ক্ষতবিক্ষত অংশটা পরিষ্কার করছিলেন। তারপরে তিনি অত্যন্ত দ্রুত ক্ষতস্থান দুটি ব্যান্ডেজ করে ফেললেন। তাঁর ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছিল, ক্ষতস্থানগুলো ঢেকে ফেলাই বৃদ্ধ ডাক্তারের একমাত্র উদ্দেশ্য।
ডক্টর ডেভিস সাধারণভাবে কৌতূহলশূন্য মানুষ। কিন্তু ডাক্তারের অদ্ভুত রকমের জেরা ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছিল। প্রায় অর্ধচেতন রুগিটিকে তিনি বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলেন। ওই অস্বাভাবিক ঘটনার প্রত্যেক মুহূর্তের বর্ণনা না শুনে তিনি যেন শান্তি পাচ্ছিলেন না। তিনি অদ্ভুতরকম উদবিগ্ন হয়েছিলেন একটা ব্যাপারে যে, বার্ক কি আদৌ নিশ্চিত সম্পূর্ণ নিশ্চিত একদম ওপরের কফিনটার ব্যাপারে? কীভাবে ওটাকে বাছাই করেছিল? ওই অন্ধকারের মধ্যে কীভাবে নিশ্চিত হল যে, ওটা ফেনারেরই কফিন ছিল? বার্ক কীভাবে ওই হতচ্ছাড়া আসাফ সইয়ারের কফিনটাকে আলাদা করতে পারল ম্যাথু ফেনারেরটার থেকে? দুটো কফিনই যদি একই রকমের আকৃতির হয়, অন্ধকারের মধ্যে হাত বুলিয়ে কি কাঠের কোয়ালিটি বোঝা সম্ভব? এত সহজে কি ফেনারের শক্তপোক্ত কফিনের ডালাটা ভেঙে যেতে পারে?
গ্রামের পুরোনো ডাক্তার হওয়ার সুবাদে ডক্টর ডেভিস ফেনার এবং সইয়ার দু-জনেরই অন্তিমশয্যায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি দু-জনেরই শেষকৃত্য দেখেছেন। তিনি তো সইয়ারের শেষকৃত্যের সময় রীতিমতো অবাকই হয়েছিলেন। ওই লম্বাচওড়া চাষিটাকে এত ছোটখাটো একটা কফিন বাক্সে, যা আদতে বেঁটে রোগা ফেনারের মতো করে বানানো, কীভাবে সোজা করে শোয়ানো সম্ভব হল।
ঘটনার প্রায় দু-ঘণ্টার পরে ডক্টর ডেভিস চলে গেলেন। যাওয়ার আগে তিনি বার্ককে পইপই করে বুঝিয়ে গেলেন যে, সমস্ত ক্ষতই তৈরি হয়েছে কফিনের ভাঙা কাঠ আর পেরেক থেকে। এ ছাড়া তিনি বললেন, আর কী-ই বা প্রমাণ অথবা বিশ্বাসের আছে? সব থেকে ভালো হয়, এই সম্বন্ধে তুমি আর কোনও কথা না বলো এবং অন্য কোনও ডাক্তারকে এই ঘা-গুলো না দেখাও। তিনি শাসিয়েছিলেন বার্ককে।
বার্ক অবশ্য তাঁর সেই উপদেশ বাকি জীবন ধরে মনে রেখেছিল। যত দিন পর্যন্ত না আমাকে তার গল্প বলেছিল। আর আমি যখন সেই পুরোনো এবং সাদা-হয়ে-যাওয়া দাগগুলো দেখছিলাম, তখন আমিও মানতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, ওই বৃদ্ধ ডাক্তার একদম বিচক্ষণের মতোই নির্দেশ দিয়েছিলেন। বার্ক অবশ্য বাকি জীবনের জন্যে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। পায়ের পেশিতন্তুগুলো মারাত্মক আহত হওয়ার জন্যে। কিন্তু আমি মনে করি, আদতে তার আত্মা পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল ওই বিভীষিকাময় আঘাতে।
একসময় বার্কের চিন্তাভাবনা যথেষ্ট শান্ত এবং যুক্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এই ঘটনার পরে তার স্বাভাবিক চিন্তাভাবনাও সারাজীবনের জন্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। এটা দেখতেও খারাপ লাগত যে, মানুষটা শুধুমাত্র শুক্রবার, কবরখানা, কফিন- এই শব্দগুলো শোনামাত্রই আতঙ্কিত হয়ে উঠত। তার ভয়ার্ত ঘোড়াটি বাড়ি ফিরতে পেরেছিল, কিন্তু তার ভয়ার্ত বুদ্ধিমত্তা আর কোনও দিনই বাড়ি ফিরে আসতে পারেনি।
বার্ক ব্যাবসা পরিবর্তন করে ফেলল। আর সে কফিন বক্স বানাত না। তবুও কিছু একটা তাকে আজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। এটা হয়তো-বা শুধুই ভয়, হয়তো-বা ভয়ের সঙ্গে মেশানো কোনও এক বিকৃত অতীত কৃতকর্মের জন্য উৎকট অনুশোচনা। তার মদ খাওয়া, অবশ্যই, সে অনুভূতিটাকে তাড়ানোর জন্যেই খেত, কিন্তু তার পরিবর্তে অনুভূতিটা আরও উগ্রতর হয়ে তার মনের মধ্যে গেড়ে বসত।