অবশেষে টাওয়ার তৈরি শেষ হল। ব্যথা-হয়ে-যাওয়া হাত দুটোকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে বার্ক এবার থামল। সিঁড়ির প্রথম ধাপে এসে বসল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বার্ক আবার তার যন্ত্রপাতি দুটো হাতে নিয়ে ধাপগুলো চড়ে দরজার ওপরের ছোট জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। ছোট জানালাটার চারপাশ ইটে গাঁথা। জানালাটা ছেনি দিয়ে ভেঙে ওই ফোকর গলে বের হওয়াটা খুব একটা সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছিল। দমাদম হাতুড়ির বাড়ি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ঘোড়াটা উচ্চকিত স্বরে ডাকতে শুরু করল। হেষাধ্বনি উৎসাহপ্রদানকারী নাকি ব্যঙ্গাত্মক, বার্ক ঠাওর করতে পারল না। অবশ্য দুটোই উপযুক্ত ছিল তৎকালীন অবস্থায়। ওই আপাত সহজ ইটের গাঁথনিটার অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা জীবিত মানুষটার আশার ওপরে হাতুড়ির ঘায়ের মতোই দমাদম আঘাত হানছিল।
সন্ধ্যা নেমে এল। বার্ক তখনও লড়ে যাচ্ছে জানালার সঙ্গে। আকাশে সদ্য গজানো মেঘের দল চাঁদটাকে ঢেকে দেওয়ার পরে অন্ধের মতোই বার্ক কাজ করে যাচ্ছিল। সাফল্যের গতি অবশ্য খুবই ধীর ছিল। অবশেষে জানালাটার ওপরে আর নীচের খানিক অংশকে ইটমুক্ত করতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত হল বার্ক। সে মোটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিল, যে মধ্যরাত্রির আগেই ছাড়া পেয়ে যাবে। অবশ্য এই চিন্তাটা সে সুস্থভাবেই করছিল। এই অতিপ্রাকৃত পরিবেশের আতঙ্ক তখনও তার হৃদয়কে গ্রাস করতে পারেনি। ওই বিশ্রী ভূতুড়ে স্থান, অলৌকিক সময়, এমনকী তার পায়ের নীচে থাকা পরপারে বন্ধুদের ঘরবাড়ি কোনওটাই তাকে ছুঁতে পারছিল না। সে প্রায় দার্শনিক উদাসীনতায় পাথুরে ইটগুলোকে ভেঙে ফেলছিল। গালাগালি দিচ্ছিল, যখন ইটের টুকরো ছিটকে এসে মুখে লাগছিল। আবার হেসে উঠছিল, যখন বাইরের উত্তেজিত ঘোড়াটাকে গিয়ে আঘাত করছিল ইটের টুকরোগুলো। ঘোড়াটা বাঁধা ছিল সাইপ্রাস গাছের তলায়। আস্তে আস্তে গর্তটা বড় হচ্ছে দেখে সে পায়ে চাপ দিয়ে নিজের শরীরটা ওর ভেতর দিয়ে গলানোর একটা প্রচেষ্টা করল। আর তক্ষুনি পায়ের তলার কফিনগুলো কড়কড় করে নড়ে উঠল। কিন্তু তার শরীরটা গর্ত অবধি পৌঁছোল না। সে বুঝতে পারল আরেকটা কফিনের উচ্চতা প্রয়োজন ওই গর্ত দিয়ে শরীর বার করতে গেলে।
তখন প্রায় মধ্যরাত্রি হবে, যখন বার্ক সিদ্ধান্ত নিল যে, সে এবার জানালা দিয়ে বেরোতে পারবে। অনেকবার বিশ্রাম নেওয়া সত্ত্বেও সে একেবারে ক্লান্ত হয়ে ঘেমে-নেয়ে উঠেছে। বাইরের খোলা প্রকৃতিতে বেরোনোর আগে সে একবার কফিনগুলো বেয়ে নীচে নেমে এল। একদম তলার কফিনের ওপরে বসে সে শেষ ঝাপটা দেওয়ার শক্তি অর্জন করছিল। বাইরে ক্ষুধার্ত ঘোড়ার ঘন ঘন হ্রেষাধ্বনিটা পরিবেশের গা-ছমছমে ভাবটা ক্রমে বাড়িয়ে তুলছিল। এতক্ষণে সে একবার অস্পষ্টভাবে প্রার্থনা করল, এই আওয়াজটা যেন থেমে যায়। তার আসন্ন মুক্তিতে খুব অদ্ভুতভাবেই সে একদমই গর্ব বোধ করছিল না। বরং, এই যৌবনের প্রান্তদেশে পৌঁছোনো অলস গেঁতো দেহটা এতখানি পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজ করে ফেলেছে দেখে তার কেমন যেন একটু ভয়ই লাগছিল।
বার্ক আবার চড়তে শুরু করল। ক্লান্ত দেহের ওজনটা তার নিজের কাছেই খুব বেশি বলে মনে হচ্ছিল। এতক্ষণে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের চাপে কফিনগুলো প্রায় ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে যখন সে একদম ওপরের কফিনটার ওপরে উঠল, সে স্পষ্ট শুনতে পেল, পায়ের তলার কফিনটা চড়চড় করে শব্দ তুলে ভাঙছে। সে অনেক ভেবেচিন্তেই সবার ওপরে সবচেয়ে শক্ত কফিনটা তুলেছিল। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছিল, তার এতক্ষণ ধরে করা সমস্ত পরিকল্পনাই জলে যেতে বসেছে।
সহসা একদম ওপরের কফিনের পচা ঢাকনা ভেঙে তার সমস্ত শরীরটা দু-ফুট নীচে নেমে এল। বার্কের মতো মানুষও কল্পনা করতে পারল না, এখন তার পায়ের তলায় কী আছে, সেই সত্যটা। বিশ্রী পচা গন্ধ এক লহমায় বাইরের বাতাসকে দখল করে নিল। ওই গন্ধে নাকি কাঠ ভাঙার ভয়ংকর শব্দটাতেই ঘোড়াটা মারাত্মক লাফিয়ে উঠে দড়ি ছিঁড়ে ছুটে পালাল। এমন উন্মাদের মতো চিৎকার করছিল জন্তুটা, যাকে হ্রেষাধ্বনির বদলে আর্তনাদ বলাটাই ভালো। যেন খুরে খুরে পিষে ফেলতে চাইছিল বাইরের রাত্রিটাকে। এমনকী পেছনে বাঁধা ঠ্যালাগাড়িটাও ঝনঝন করে উঠল ওই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োনোয়।
পায়ের তলার কফিনটা ভেঙে যাওয়ার ফলে এখন বার্ক গর্তটার ধার ধরে ঝুলছে। ওই ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যেই বার্ক মনের জোরে নিজের শক্তি একত্রিত করতে লাগল। কোনওরকমে গর্তের ধারটা দু-হাতে ধরে নিজেকে টেনে ওপরে তুলতে চাইল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করল, গোড়ালি দুটো ধরে কে যেন তাকে তলার দিকে টানছে। সেই রাত্রিতেই সেই প্রথমবার তার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এল। সে ওঠার জন্য যত চেষ্টা করতে লাগল, তত তার পায়ের টান ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। কিছুতেই সেই অমানুষিক হাত দুটো থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছিল না বার্ক। মারাত্মক ক্ষত তৈরি হওয়ার অসম্ভব যন্ত্রণা যেন দু-পায়ের গোছ থেকে বিদ্যুতের মতো উঠে এল। যতই সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে, ওটা বাক্সের ভাঙা কাঠের টুকরো বা খুলে-আসা পেরেক, ততই তার মনের মধ্যে তৈরি-হওয়া সমস্ত যুক্তিবাদ আদতে মিশে যাচ্ছিল এক তীব্র ভয়ের ঘূর্ণিতে। এতক্ষণে সে চিৎকার করে উঠল। প্রায় পাগলের মতোই লাথি মারতে শুরু করল সে। ক্রমশ তার চেতনা ডুবে যাচ্ছিল অন্ধকারে।