যেইমাত্র সে ম্যাটের কফিনটা চিহ্নিত করেছে, অমনি জোর হাওয়ায় শবঘরের দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরটা আগের থেকেও বেশি অন্ধকার হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বার্ক হাতড়ে হাতড়ে দরজার দিকে এগোতে লাগল। দরজার ওপরে শিক-লাগানো হাওয়া চলাচলের অংশটা দিয়ে ক্ষীণ আলোর রেখা আসছিল।
সেই শবতুল্য পাংশু গোধূলির আলোতে বার্ক দরজার জং-ধরা হুড়কোটা ধরে ঘড়ঘড় শব্দ করে টানাটানি করতে লাগল। ধাক্কা দিতে লাগল লোহার পাল্লায়। সে অবাক হয়ে ভাবতে থাকল, এই বিশাল দরজাটার এমন কী হল, যে ব্যাটা এত অবাধ্য হয়ে উঠেছে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই গোধূলির ম্লান আলোতে সে অনুভব করতে শুরু করল সত্যটা। এইবার বার্ক গলা ছেড়ে চিৎকার করতে শুরু করল। অবশ্য ওই জনহীন প্রান্তরে গুড ফ্রাইডের বিকেলবেলা মানুষের আসার সম্ভাবনা এতই কম; বার্কের মনে হচ্ছিল, সে যেন এই আশায় চিৎকার করছে যে, বাইরে থেকে তার ঘোড়াটা যেন সহানুভূতিহীন হেষাধ্বনি করা ছাড়া আরও কিছু করতে পারে। অবশ্যই শবঘরের প্রতি দীর্ঘ অবহেলায় দরজার হুড়কোটা ভেঙে গিয়েছিল। এই উদাসীন কর্মচারীটি নিজেই নিজের ভুলে শিকার হয়ে আটকে পড়ল শবঘরের মধ্যে।
ঘটনাটি ঘটেছে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ। বার্ক তার বাস্তববাদী স্বভাবের জন্য বেশিক্ষণ চিৎকার করল না। সে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে শবঘরের মধ্যে যেখানে কফিন বানানোর যন্ত্রপাতি রাখা ছিল, সেগুলো খুঁজতে শুরু করল। এই ভয়ংকর অবস্থাটার আতঙ্ক এখনও তাকে ছুঁতে পারেনি। কিন্তু গুড ফ্রাইডের দিনে জনমানুষহীন এই প্রান্তরে শবঘরের মধ্যে আটকা পড়ার সত্যটা তাকে ক্রমশই রাগিয়ে তুলছিল। একে তো তার সেই দিনের কাজেরও বারোটা বেজে গেল। এখন হয়তো তাকে সারারাত অথবা কালকের দিনটাও এইখানে বন্দি থাকতে হবে! যতক্ষণ না ভাগ্য সদয় হয়ে কাউকে নিয়ে আসে এই রাস্তায়।
যন্ত্রপাতিগুলো খুঁজে পেতেই বার্ক কাজে লেগে গেল। একটা ছেনি আর হাতুড়ি নিয়ে সে আবার কফিনগুলোর মধ্যে দিয়ে দরজার দিকে ফিরে এল। ইতিমধ্যে বদ্ধ ঘরের বাতাস ক্রমে দুর্গন্ধে ভ্যাপসা হতে শুরু করেছে। কিন্তু মরচে ধরে ক্ষয়ে-যাওয়া ভারী হুড়কোটার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে, অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে সে মাথাই ঘামাল না। অবশ্যই কাজটা আরও ভালোভাবে করা যেত, যদি একটা লণ্ঠন বা মোমবাতি থাকত। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে প্রায় অন্ধভাবেই সে কোনওরকমে হুড়কোটাকে ঢিলে করার চেষ্টা করতে লাগল।
যতক্ষণে বার্ক বুঝতে পারল, এই অন্ধকার অবস্থায় এই সামান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে এই হুড়কোটাকে কোনওভাবেই নড়ানো সম্ভব নয়, ততক্ষণে অন্ধকার জমিয়ে নেমে এসেছে।
এবার বার্ক মুক্তির অন্য সম্ভাবনাগুলোর কথা ভাবতে লাগল।
এই শবঘর একটা পাহাড়ের প্রান্তদেশ খনন করে তৈরি করা হয়েছিল। বায়ুচলাচলের চিমনিটা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েক ফুট খাড়া উঠে গিয়ে তবে বাইরে বেরিয়েছে। ওই চিমনি বেয়ে ওঠা কোনওমতেই সম্ভব নয়। দরজার ওপরে, অনেকটা উঁচুতে ইটে গাঁথা সরু সরু জানলা, যেটা বার্কের পক্ষে ভেঙে বড় করা সম্ভব।
জানালাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বার্ক মাথা চুলকে টাক করে ফেলল। কীভাবে অত উঁচুতে পৌঁছোনা যায়? শবঘরের মধ্যে কোনওরকম মইয়ের মতো কিছু ছিল না। কফিনগুলো যত্ন করে ঘরের দু-পাশে এবং পেছনদিকে মেঝের ওপরে রাখা ছিল, যেখান থেকে ওগুলোকে টেনে বার করতে বার্কের বেশ অসুবিধা হত।
এবার জানালাটা ছেড়ে বার্ক ঘরের কফিনগুলোর প্রতি মনোযোগ দিল। একমাত্র এগুলোকে দিয়েই সিঁড়ি বানানো সম্ভব। বার্ক হিসাব কষে দেখল, তিনটে কফিন উপর্যুপরি সাজালেই সে পৌঁছোতে পারবে জানালার কাছে। কিন্তু সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে তাকে ওই জানালাটা কাটতে হবে। কাজটা ভালোভাবে করার জন্যে উপর্যুপরি চারটে কফিন সাজালে ব্যাপারটা সিঁড়ি হিসাবে আরও সন্তোষজনক হয়। বাক্সগুলো উচ্চতায় প্রায় সমান। এদেরকে ইটের মতো পাকারে সাজানো সম্ভব। এবার বার্ক খুব গভীরভাবে হিসাব করতে শুরু করল, কীভাবে আটটা মাত্র কফিন দিয়ে চারটে দৃঢ় স্তর তৈরি করা সম্ভব। ছক কষার সময় তার মনের মধ্যে একটু ভয়-ভয় করছিল, অবশ্য সেটা কফিন বক্সে ব্যবহৃত কাঠের দৃঢ়তা নিয়ে। স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় পায়ের তলার বক্সগুলো খালি কি ভরতি, সেটা তার কল্পনাতেও আসেনি।
অবশেষে হিসাব ছকা হয়ে গেল। তিনটে বাক্সকে দেওয়ালের সমান্তরালে ভিত্তি হিসাবে সাজাবে, তার ওপরে দুটো স্তরে দুটো-দুটো করে বাক্স রাখবে, একদম শেষে সবার ওপরে একটি বাক্সকে প্ল্যাটফর্ম হিসাবে রাখবে। ওপরে ওঠার এই বন্দোবস্তটাই সব থেকে কম ঝামেলার। এতেই দিব্যি সঠিক উচ্চতা ওঠা যাবে। যদিও বার্ক ভাবছিল, এই সুপার স্ট্রাকচারটার তলায় যদি তিনটের বদলে দুটো বাক্স রাখা যায় তাহলে তার হাতে আরও একটা বাক্স বাড়তি থাকে। আসলে পালাবার জন্যে যদি আরও বেশি উচ্চতার দরকার হয়, তাহলে সে সেটাকে ব্যবহার করতে পারবে।
যা-ই হোক, এবার আমাদের বন্দি প্রায় মিলিয়ে আসা গোধূলি আলোতেই পরিশ্রম করে চলল। নিঃসাড় মৃতদের অবশিষ্টাংশের বাসস্থানগুলোকে সরানোর সময় সে ঘন ঘন কুশ এঁকে নিচ্ছিল বুকের মধ্যে। নাড়াচাড়া করার সময় কিছু কফিন খুলে যেতে শুরু করল। যাতে ওপরে ওঠার সময় পায়ের তলার বাক্সটা ভেঙে না যায়, তাই সে ঠিক করল, বেঁটেখাটো ম্যাথু ফেনারের শক্তপোক্ত আধারটিকে সে একদম ওপরেই রাখবে। এই আলো-আঁধারির মধ্যে সে কফিনগুলো স্পর্শ করে করে সঠিক কফিনটা বোঝার চেষ্টা করছিল। তৃতীয় স্তরে সে যখন বোকার মতোই নির্বাচিত একটা কফিনকে রাখছিল, তখন হঠাৎ অসতর্কভাবেই কফিনটা উলটে পড়ে যায়। কোনওমতে কফিনগুলোকে একের পর এক সাজিয়ে একসময় বার্ক ঠিক তার টাওয়ার অব ব্যাবেল তৈরি করে নিল।