পারদর্শী গল্প-বলিয়ে হলে এসব উলটোপালটা না বলে, বার্কের গল্পটা আমি বেশ জমিয়েই শুরু করতে পারতুম। গল্পটা শুরু হয়েছিল ১৮৮০ সালের সেই শীতল ডিসেম্বর মাস থেকে। সেইবার এতই ঠান্ডা পড়েছিল যে, পেক ভ্যালি গ্রামের মাটিও জমাট বেঁধে গিয়েছিল শক্ত বরফের মতোই। কবরখানার খোদাইকর্মীরা বুঝতে পারছিল, তারা বসন্ত না-আসা পর্যন্ত আর কবর দেওয়ার জন্যে মাটি কাটতে পারবে না। ভাগ্যক্রমে গ্রামটা ছিল ছোট। মৃত্যুহারও আনুপাতিকভাবে কমই ছিল। বার্কের দায়িত্বে থাকা প্রাণহীন পদার্থগুলিকে একটা ক্ষণস্থায়ী স্বর্গলাভের ব্যবস্থার জন্য, পাহাড়ের গায়ে একটা গুহাকে শবঘর বিবেচনা করে, তার মধ্যে তাদেরকে রাখার ব্যবস্থা করা হল।
শবঘরের একমাত্র কর্মী বার্ক এই নিদারুণ ঠান্ডা আবহাওয়ায় দ্বিগুণ জবুথবু হয়ে গিয়েছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে, অলসতায় সে নিজেই নিজেকে টেক্কা দেবে। শবঘরের মধ্যে হাঁটতে গেলেই সে কফিনগুলোয় অনবরত ঠোকা খাচ্ছিল। কোনওরকম সাবধানতা ছাড়াই শবঘরের দরজার পাল্লা দুটোকে দুমদাম করে বন্ধ করছিল।
অবশেষে বরফ-গলানো বসন্ত এল। অনেক পরিশ্রমে নয়খানা কবর খোঁড়া হল কবরখানায়, বহুপ্রতীক্ষিত নয়জন স্বর্গলোভীর কবর, যারা শবঘরের মধ্যে অপেক্ষা করছিল, তাদের যাত্রা শুরুর জন্যে। এক দুর্যোগপূর্ণ এপ্রিলের সকালে বার্ক জড়তা কাটিয়ে উঠে কাজ শুরু করল বটে, কিন্তু ঘোড়াটার ত্যাঁদড়ামির চোটে মোটে একটামাত্র কফিনই কবর দিতে পারল। নব্বই বছরের বুড়ো দারিয়াস পেকের কফিনটা।
বার্ক অবশ্য ভেবেছিল, পরের দিনই ম্যাথু ফেনারকে কবর দিয়ে দেবে। কিন্তু আলসেমি আর ভাগ্য দুইয়ে মিলে বার্ক তিন দিনের আগে কাজে হাতই দিতে পারল না। ১৫ তারিখ গুড ফ্রাইডের দিন সে ঘোড়ার গাড়িটা নিয়ে খুটখুট করে পাহাড়ে উঠল, শবঘরের উদ্দেশে। মাথু ফেনারের কফিনটাকে কবর দিয়ে দেওয়াই যাক। গুড ফ্রাইডের দিন কাজ করা উচিত নয়। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন না হয়ে সে ফেলে-রাখা কাজটা চুকিয়ে দিতে গেল। অবশ্যই সেই দিনের সন্ধের ঘটনাই জর্জ বার্কের জীবনটাকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল।
১৫ এপ্রিল, শুক্রবার বিকেলে সে সামান্য মদও খেয়েছিল। পরে সে এটা স্বীকার করেছিল। যদিও এখনকার মতো সব ভুলে যাওয়ার মতো পাঁড়মাতাল সে তখন হত না, সে কথাও বলেছিল। সে দিন তার উদোমাদাভাবে গাড়ি চালানোটাই ঘোড়াটাকে যথেষ্ট বিরক্ত করে তুলছিল। বেশ কয়েকবার চিঁহি ডাক ছেড়ে, খুর ঠুকে, কেশর নাচিয়ে বিরক্তির চরম সীমায় গিয়ে ঘোড়াটা কোনওমতে গাড়িটাকে টেনে টেনে পাহাড়ের কাছে নিয়ে এসেছিল। অবশ্য আগের দিনের মতো সেই দিন বৃষ্টি হচ্ছিল না, বিকেলটা বেশ পরিষ্কারই ছিল। কিন্তু পাহাড়ের কাছে আসতেই একঝলক ঝোড়ো হাওয়া টিলাটাকে ঘিরে দাপিয়ে উঠল।
বার্ক বেশ খুশি হল যে, ঝড়বৃষ্টি আসার আগেই সে শবঘরের ছাদের তলায় ঢুকে যেতে পারবে। অন্য কেউ হলে হয়তো ওই ড্যাম্প-ধরা, দুর্গন্ধযুক্ত চেম্বারের মধ্যে আশ্রয়ের লোভে ঢোকার কথা স্বপ্নেও ভাবত না। অন্তত যেখানে আটখানা কফিন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু সেই সময় বার্ক এতটাই সংবেদনহীন ছিল যে, ওইসব পারিপার্শ্বিক অবস্থায় তার কিছু যেত-আসত না। সে শুধু চিন্তিত ছিল সঠিক কফিনটাকে সঠিক কবরে ঢোকানো নিয়ে। আগের বার ঘটিয়ে-ফেলা কাণ্ডটা সে একদমই ভোলেনি। কী কেলেঙ্কারি! সেইবার যখন হানাহ্ বিক্সবির আত্মীয়রা চেয়েছিল তাঁর দেহটাকে অন্য এক শহরে নিয়ে যেতে, যেহেতু তারাও এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কবর খুঁড়ে হানাহ্ বিক্সবির হেডস্টোনের তলায় পাওয়া গিয়েছিল জাজ ক্যাম্পয়েলের কফিন বক্স। খুব গোলমাল আর সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সেইবার তাকে ঘিরে। আর যা-ই হোক-না কেন, ওইরকম ভুল যেন আর না হয়। বার্ক দরজাটা খুলে শবঘরের মধ্যে ঢুকল।
আলোটা টিমটিম করে জ্বলছিল। তাতে অবশ্য বার্কের দেখতে কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। সে আসাফ সইয়ারের কফিনটা টানেনি। যদিও সেটা প্রায় একই রকমের দেখতে ছিল। তার স্পষ্ট মনে আছে, ওই কফিনটা সে ম্যাথু ফেনারের জন্যেই বানিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সরিয়ে রেখেছিল ওই বিশ্রী ঠুনকো কাঠের তৈরি কফিনটাকে। এই ব্যাপারটার পেছনে অবশ্যই তার প্রায় হারিয়ে-যাওয়া অনুভূতিটুকু কাজ করেছিল। পাঁচ বছর আগে যে ব্যাঙ্কে সে সমস্ত টাকা গচ্ছিত রাখত, ওটার গণেশ ওলটানোর সময় ওই বৃদ্ধ তাকে কতটা সাহায্য করেছিল। বৃদ্ধ ম্যাথু ফেনারের কফিনটা যতটা যত্ন সহকারে বানানো সম্ভব, সে বানিয়েছিল। আর পরক্ষণেই সমস্ত অনুভূতি শিকেয় তুলে, হিসেবি মানুষের মতোই সরিয়ে-রাখা ওঁচা কফিনটাতে মৃত আসাফ সইয়ারকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বার্ক।
ম্যালিগন্যান্ট জ্বরে মৃত সইয়ার মোটেও ভালো মানুষ ছিল না। ব্যক্তিগত প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে লোকটার অনমনীয় স্মৃতিশক্তি এবং অমানুষিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা, তাকে ঘিরে প্রচুর গল্প তৈরি করেছিল। অবশ্যই তার প্রতি বার্কের কোনওরকম ভাবালুতা ছিল না। এমনকী একটা ফেলে-রাখা, মাপ নিয়ে তৈরি না-করা কফিনে সইয়ারের মৃতদেহকে ঢুকিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও বার্কের কোনওরকম অনুশোচনা ছিল না।