না না– এসব কী ভাবছি আমি? আমি সে নই, আমি আমার স্বপ্নে দেখা সেই শয়তানরূপী কদাকার অবয়ব নই!! ছত্রাকে পূর্ণ ওই বীভৎস থলথলে মুখটা এড নরিসের হতে পারে না!!
কে বলেছে আমি ডেলাপোর? শালা নরিস বেঁচে রইল, আর আমার ছেলে মরে গেল?? কে নরিস? সে কিনা ডেলাপোরের সম্পত্তি দখল করে থাকবে? ওহে থ্রনটন, চাঁদবদন আমার!! এটাই আসলি কালাজাদু, বুঝলে সাপের ছোবল হিসসস!!! আবার জ্ঞান হারাবে নাকি?? কোনও সমস্যা নেই!! আমি তোমাকে দেখাব, কীভাবে আমাদের পরিবারের প্রাচীন কাজকর্মের প্রভাবে তোমার স-জ্ঞানকে অ-জ্ঞানে পরিণত করা যায়।
রক্ত চাই রক্ত, বুঝলি ইতর!! রক্ত– তোর রক্ত চাই। কীভাবে ছোবল মারবি, আমি দেখাচ্ছি, দেখ!! ম্যাগনা মাতের! ম্যাগনা মাতের!! আতিয়াস দিয়া আদ আদান আগুস বাস দুনাত ওরট– আগুস লেট সাআআআআআআ–উররর রাআআআহহ সসসসস!!!!!!
প্রায় তিন ঘণ্টা পর ওরা যখন আমাকে এই অন্ধকার কুঠুরির তলা থেকে উদ্ধার করে, তখন নাকি এই শব্দগুলো আমি ক্রমাগত আওড়ে যাচ্ছিলাম। ওরা আরও বলে, আমি নাকি ক্যাপটেন নরিসের আধখাওয়া দেহের ওপরে হামাগুড়ি দিচ্ছিলাম। আমার নিজের বেড়াল কালো মানিক নাকি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার টুটি ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করছিল। এক্সাম প্রায়োরিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চিরকালের জন্য। ওরা কালো মানিককেও আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে, আর আমাকে পুরে দিয়েছে। হ্যানওয়েলের এই ছোট্ট ঘরে। আমি বুঝতে পারছি, আমার পরিবার নিয়ে, এবং আমাকে নিয়ে নানা কুৎসা রটানো হচ্ছে আমার চারপাশে। প্রায়োরির সব রহস্য চেপে দেওয়ার চেষ্টা করছে এরা!! বেচারা নরিসের কথা জিজ্ঞেস করলে আমার ওপর বীভৎস সব আরোপ লাগাচ্ছে, কিন্তু তাদের জানতে হবে, এসবের জন্য আমি দায়ী নই!! ওদের জানতে হবে ওই ইঁদুরগুলোর কথা। সেই ঘিনঘিনে মূষিকের দল, যাদের খড়খড়ে চলাফেরা, ক্রমাগত উল্লম্ফন আমাকে একটুও ঘুমোতে দেয় না। শয়তানের দল সারাক্ষণ এই ঘরের দেওয়ালের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমাকে ডাকছে মাটির গভীরে, আরও নিবিড় আতঙ্কের যাত্রাতে তাদের সঙ্গে শামিল হতে।
এরা কোনও দিন এই বীভৎস ডাক শুনতে পাবে না। কেবল আমি পেতে থাকব, চিরটাকাল! ওই ইঁদুরের দলের ঘিনঘিনে আওয়াজ যা ভেসে আসছে ওই দেওয়ালের ভেতর থেকে।
[প্রথম প্রকাশ: গল্পটি ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে উইয়ার্ড টেলস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। ভাষান্তর : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়]
শবঘর
শবঘর (IN THE VAULT)
[এই গল্পের সূত্র লাভক্র্যাফটকে দেন ট্রাই আউট পত্রিকার সম্পাদক চার্লস ডব্লিউ স্মিথ। ১৯২৫ সালে উইয়ার্ড টেলস পত্রিকা গল্পটি বাতিল করে দেয় গল্পে প্রচণ্ড হিংস্রতা থাকা অভিযোগে। ট্রাই আউট গল্পটি প্রকাশ করলেও ঘোস্ট স্টোরিজ নামের এক পাল্প পত্রিকায় গল্পটি পরে জমা দেন লাভক্র্যাফট। সেখানেও গল্পটি অমনোনীত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ সালে গল্পটি ছাপে উইয়ার্ড টেলস।]
এরকম অবাস্তব আর কিছু কখনও শুনিনি। সাধারণ একজন মানুষের মনস্তত্ত্বে এরকম অদ্ভুত কিছু একটা বাসা বেঁধেছে তা ভাবাও যায় না। আমেরিকান গ্রাম্য পরিবেশ, একটা ষণ্ডামার্কা কবরখানার কর্মচারী আর অনবধানবশত ঘটে-যাওয়া একটা দুর্ঘটনা। যে-কোনও সাধারণ গল্প-বলিয়ে এর থেকে একটা স্থূল রকমের হাস্যরসের গল্প টেনে বার করতে পারত। কিন্তু জর্জ বার্ক যে কীভাবে… লোকটা নিজের জীবন দিয়ে যে পঙ্কিল অন্ধকারকে উপলব্ধি করেছে, তার কাছে আমাদের জীবনের কদর্যতম মুহূর্তগুলিকেও অত্যন্ত ফ্যাকাশে লাগে। আজ জর্জ বার্কের মৃত্যু আমাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার সম্মতি দিয়েছে এই গল্পটা। এই দুনিয়ার এক চরমতম ভয়ংকর মনস্তাত্ত্বিক গল্প।
১৮৮১ সাল নাগাদ বার্ক যে কেন হঠাৎ নিজের আদি ব্যাবসা আর বাসস্থান পরিবর্তন করল তা কেউই জানত না। ব্যাপারটা নিয়ে সে কখনওই কারও সঙ্গে কথা বলেনি। জানতেন শুধু তার পুরোনো ফিজিশিয়ান ডক্টর ডেভিস। বেশ কিছু বছর আগেই ডক্টর ভদ্রলোক খবরটা সঙ্গে করে কবরে গেছেন। ডক্টর ডেভিসের মৃত্যুর পরে বার্কের কাউকে দরকার ছিল কথাগুলো বলার। তার বিয়েও হয়নি, দুই কূলে কোনও আত্মীয়স্বজনের চিহ্নও ছিল না। এমত অবস্থায় নিজের ডাক্তার ছাড়া আর কাকেই বা সে কথাগুলো জানাবে?
সাধারণ মানুষ জানত, ওই দুর্ভাগ্যবশত ঘটে-যাওয়া ঘটনাটাই বার্ককে মানসিকভাবে বিগড়ে দিয়েছিল। যতই শক্তপোক্ত মানুষ হোক, প্রায় নয় ঘণ্টার জন্যে পেক ভ্যালি সিমেট্রির শবঘরে বন্দি থাকা আর শেষ পর্যন্ত ওইরকম সর্বনাশা পদ্ধতিতে রাস্তা বানিয়ে বেরিয়ে আসা! নাহ্ গল্পটা যে-কোনও সাধারণ মানুষের আঁতকে ওঠার জন্যেই যথেষ্ট। কিন্তু ওই সত্য গল্পের পেছনে ছিল আরও কিছু ভয়ংকর সত্য, যা মানুষটা মদের ঘোরে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার কানের কাছে ফিশফিশ করে বলে গেছে।
১৮৮১-র আগে জর্জ বার্ক পেক ভ্যালি গ্রামের কবরখানার কর্মচারী ছিল। বার্ককে যে শুধুই অপেশাদার বলা যায় তা-ই নয়, সে নিজের কাজেও যথেষ্ট অমনোযোগী ছিল। শবাগারের মধ্যে যে কাজ সে করেছিল তা আজকের দিনে অকল্পনীয়, অন্তত শহরের বুকে। পেক ভ্যালির লোকজনও যদি ওটা শুনত, তাহলে তারা ভয়ে শিউরেই উঠত, যে তাদের শবাধার শিল্পীর নীতিবোধ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঠিক বন্ধ কফিন বক্সের ভেতরের কাপড়ের মতোই দৃষ্টির অগোচর ছিল। মৃতদেহের প্রতি লোকটার ভদ্রতাবোধ কখনও কখনও সঠিক তুল্যমূল্য বিচার করে চলত না। খুব ঠিকঠাকভাবে বলতে গেলে গন্ডারের চামড়াওয়ালা বার্ক ছিল আদতে স্থূলরুচিসম্পন্ন আর অপেশাদার, তবুও আমি বার্ককে খুব শয়তান মানুষ হিসাবে ভাবতে পারিনি। সে খানিকটা মোটা মাথার মানুষ ছিল– অনুভূতিশূন্য, অসাবধান এবং মাতাল। তার অ্যাক্সিডেন্টটাই এটা প্রমাণ করে দেয়। ওই অ্যাক্সিডেন্টটা সে অতি সহজেই এড়াতে পারত। আসলে তার মধ্যে সাধারণ মানুষের রুচি, নীতিবোধ, এমনকী কল্পনাশক্তির বিন্দুমাত্রও ছিল না।