আমি বরং স্যাক্সন স্থাপত্যের মধ্যে প্রবেশ করলাম। অট্টালিকার ওক কাঠের দরজা ভেঙে খুলে গেছে। ভেতরে ঢুকেই দেখলাম খান দশেক অন্ধকার কুঠুরি, ঠিক জেলখানার মতো। সামনের লোহার শিকগুলোতে মরচে পড়ে গেছে। তিনটে কারাগারে একটা করে কঙ্কাল শায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এদের মধ্যে একজনের হাড়ের আঙুলে একটা আংটি দেখলাম, যার ওপরে খোদিত মোহরটি আমাদের বংশে এখনও ব্যবহৃত হয় নানা সরকারি কাজে। স্যার উইলিয়াম, রোমান প্রার্থনাকক্ষের নীচের অংশে এরকমই আরও একটা কারাগার আবিষ্কার করলেন। সেগুলো যদিও আরও প্রাচীন– তবে সবই খালি। ড. ট্রাস্ক একটা প্রাগৈতিহাসিক সমাধিস্তূপ ভেঙে পরীক্ষা করতে লাগলেন। সেখান থেকে পাওয়া খুলিটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, গোরিলার থেকে সামান্য উন্নতমানের মনুষ্যেতর জীবের মাথার খুলি সেটি– তাতে আবার অদ্ভুত সব প্রাচীন চিত্রলিপি খোদাই করা আছে।
এত ঘটনা এবং নিরন্তর নব নব আবিষ্কারে মধ্যে ডুবে থাকলেও আমি আড়চোখে কালো মানিকের দিকে নজর রেখেছিলাম। এত কিছুর মধ্যেও আমার বেড়াল কিন্তু নিরুত্তাপ থেকেছে। মাঝে একবার একছুটে উঠে গিয়েছিল হাড়ের স্তূপের একদম চূড়ায়, সেখানেই বসেছিল কিছুক্ষণ। ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে তার হলুদ চোখের চাহনি দিয়ে হয়তো-বা বুঝতে চাইছিল এই জায়গার রহস্য।
এরকম ভয়ানক সব অভিজ্ঞতালাভের পর, আমরা গুহার একটু ভেতরে ঢুকতে গেলাম যেখানে বাঁধের ফাটল দিয়ে আসা কোনও আলোর রশ্মি এখনও ঢুকতে পারেনি। সেখানে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম আমি। এ-ও সম্ভব! আমার দুঃস্বপ্নে বারবার যে জায়গাটা আমাকে তাড়া করে এসেছে, আমি ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমাকে কি তাহলে এত দিন এই ভয়ানক রহস্যময় জায়গা হাতছানি দিয়ে এসেছে? আলোর সীমানা অতিক্রম করে আমরা ক্রমশ নিবিড় অন্ধকারের রাজ্যে ঢুকে চললাম। এর ভেতর আরও কি রহস্য তার মায়াজাল বিস্তার করে আছে, সে বিষয়ে জানার কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠেছিল। যদিও জানতাম, একসঙ্গে এত কিছু জেনে ফেলা আমাদের পক্ষে মোটেই উচিত কাজ হচ্ছে না।
কিছু রহস্যকে হয়তো রহস্য রেখে দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
বেশি দূর যেতে হল না। আমাদের টর্চের আলো গিয়ে পড়ল গুহার গভীরে ছোটবড় অসংখ্য গর্তের মধ্যে। দেখে বোঝা গেল, এখানেই এই মাংসাশী মূষিকশ্রেণি তাদের শিকারকে ছিঁড়ে খেত। খাদ্যের অভাব কেবল খাদ্যের বিপুল অভাবেই তারা তাদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিল। প্রথমে শেষ করেছিল পোষা চতুষ্পদের পালকে, এবং তারপর তাদের বিশ্বগ্রাসী ও রক্তলোলুপ পৈশাচিক খিদে নিয়ে তারা প্রায়োরি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল একদিন রাত্রে৷
হে ঈশ্বর। এ কী দৃশ্য! প্রতিটি গর্ত কেবল শুকনো মাংস এবং হাড়ের স্তূপে পরিপূর্ণ। হাড়ের টুকরো এবং খুলির অংশগুলো অবধি টুকরে-খাওয়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই পৈশাচিক শয়তানের দল তাদের বিকৃত ক্ষুধা মিটিয়ে এসেছে নানা ধরনের প্রাণীদের শিকার বানিয়ে। তাদের হাড়গোড়ে পূর্ণ করেছে তাদের অন্ধকার কোটর। এক-একটা যে কত গভীর তা টর্চের আলো ফেলেও পরিষ্কার অনুমান করা সম্ভব নয়। কত শতাব্দী ধরেই না জানি এই হতভাগ্য মূষিকের দল কৃমিকীটের মতো উঠে আসছে এই কুম্ভীপাক নরকের নিঃসীম অন্ধকার থেকে।
হঠাৎ আমার পা পড়ল একটা হাঁ করে থাকা নরকঙ্কালের ওপর। চকিতে কিছুটা পিছলে গিয়েছিলাম। চারপাশে চোখ পড়তেই ভয়ে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। আমি হয়তো দেখতে গিয়ে একটু বেশিই মনোযোগী হয়ে থাকব, তাই খেয়াল করিনি যে, বাকিরা কখন আমার পাশ থেকে চলে গেছে। টর্চটা জ্বালিয়ে দেখলাম কেবল একটু দূরে ক্যাপটেন নরিস দাঁড়িয়ে। ওঁকে চিৎকার করে ডাকতে যাব, সেই মুহূর্তেই সেই পরিচিত শব্দটা কানে এল। যেন কোন অসীম থেকে ভেসে আসছে সেটা। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে আর ক্রমশ এগিয়ে আসছে। দেখতে পেলাম, আমার কালো বেড়ালটা মুহূর্তে আমার পাশ দিয়ে তিরের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল। আমিও তড়িৎগতিতে ফেরবার রাস্তা ধরলাম। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। খড়মড় করে বীভৎস শব্দে, খলবলে নারকীয় মূষিকদলের ছুটে আসার আওয়াজ ক্রমশই তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগল। এই পৈশাচিক জন্তুগুলো প্রতি মুহূর্তেই নতুন আতঙ্কের জন্মদাতা। এরা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে, টেনে নিয়ে যাবে সুদূর নরকে, যেখানে অপেক্ষা করে রয়েছে আননহীন এক কিলবিলে শয়তান, নায়ারলাথোটেপ–যার মোহনবাঁশির মতো ভয়ংকর আর্তনাদে মোহিত হয়ে ছুটে আসে রক্ত-খদ্যোতের দল।
আমার টর্চের আলো নিবে গেছে, কিন্তু তবু আমি দিশাহীনভাবে ছুটে চলেছি উন্মাদের মতো। দূর থেকে যেন কারও গলার স্বর শুনতে পাচ্ছি। কেউ যেন আর্তনাদ করে উঠছে– সেই আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে সেই বিশাল ভূগর্ভস্থ নরকের প্রাকারে প্রাকারে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আরও তীব্র তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে সেই শব্দ–রক্তলোলুপ ইঁদুরের দলের এগিয়ে আসার কুটিল, ভয়ংকর, ঘৃণ্য শব্দ– সেটা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। ছুটতে ছুটতে কিছুতে একটা যেন হোঁচট খেলাম– কীরকম নরম আর তুলতুলে একটা জিনিস। নিশ্চয়ই সেই রক্তলোলুপ শয়তানের দল গায়ের ওপর এসে গেছে। ঘিনঘিনে থকথকে কি কদাকার সেই পিশাচেরা, যারা মড়া এবং জ্যান্ত এই দুই ধরনের প্রাণীকেই মহানন্দে ভোজন করে। বিদ্যুৎচমকের মতো আমার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল– তাহলে ইঁদুরগুলো ডেলাপোরদের ভক্ষণ করল না কেন? ডেলাপোররা নিষিদ্ধ কিছু খেত বলে? যেমন যুদ্ধটা আমার ছেলেকে খেয়েছে? মর শালারা!! ইয়াঙ্কিগুলো কিনা কারফ্যাক্সের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল– শয়তানগুলো দাদুকে কিনা জ্বালিয়ে মেরে দিল!!