আর কিছুটা এগিয়েই এমন দৃশ্য দেখতে পেলাম যে, আতঙ্কে আমাদের নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের দলের আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানী খ্রনটন সেদিকে তাকিয়েই জ্ঞান। হারিয়ে তাঁর ঠিক পেছনের লোকটির কোলের ওপর লুটিয়ে পড়লেন। নরিসের গোলগাল মুখও ফ্যাকাশে হয়ে চুপসে গেল, আর সে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠল। হয়তো আমিও সেরকমই কিছু একটা শব্দ করে চোখ চাপা দিয়েছিলাম। আমার পেছনে থাকা দলের সদস্যটির গলা দিয়ে বেরিয়ে এল বহুশ্রুত সেই শব্দবন্ধটি– হে ভগবান! সাত সাতটা আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাওয়া পুরুষের মধ্যে কেবল স্যার উইলিয়াম ব্রিন্টন বুক চিতিয়ে খাড়া রইলেন। তিনি যেহেতু পুরো দলের নেতা, তাই তাঁর দুর্বলতা প্রকাশ শোভা দেয় না। আর তা ছাড়া, দলের পুরোভাগে থাকার জন্য তিনি হয়তো আমাদের ঘটনাস্থলে পৌঁছোনোর আগেই দৃশ্যটি দেখেছিলেন, তাই তাঁর দ্বিতীয়বারের প্রতিক্রিয়া এতটা ভয়াবহ হয়নি।
আমাদের সামনে আলো-আঁধারিতে ঘেরা এক বিশাল গুহামুখ। অকল্পনীয় উঁচু তার প্রাকার। কতটা গভীর যে তার বিস্তৃতি, চোখে দেখে তার কোনও আন্দাজও পাওয়া যায় না। ভূগর্ভস্থ এই দুনিয়া যেন রহস্যের খাসমহল, ভয়ংকরের অভয়ারণ্য! এদিক-ওদিক নানা স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছে। একঝলক তাকিয়ে দেখলাম, প্রাচীন সমাধিস্কৃপের সারি– এক অদ্ভুত বিন্যাসে সাজানো। কবরের উপরে বসানো মাটির স্তূপ, রোমানদের গম্বুজাকার স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ, স্যাক্সন স্থাপত্যের ছড়িয়ে-থাকা টুকরো, কাঠের তৈরি প্রাচীন ও বিশালাকার ইংরেজ স্থাপত্য কিন্তু এসব ছাপিয়ে এক হাড়-হিম-করা পৈশাচিক দৃশ্য মেঝের ওপরেই ছড়িয়ে রয়েছে। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার ফুটখানেক দূরেই বীভৎসভাবে জট-পাকানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে মানুষের হাড়। শয়ে শয়ে স্কুপের মতো। মানুষ এবং মনুষ্যেতর কোনও দু-পেয়ে জন্তুর, যাদের হাড় আমরা সুড়ঙ্গের মুখেও দেখে এসেছি। সমুদ্রের সাদা ফেনার মতো সামনে পড়ে রয়েছে সেই সফেদ চকচকে হাড়ের সারি। কঙ্কালের সারি দেখে আন্দাজ করা কঠিন নয়, এদের কেউ কোনও মাংসাশী দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে, কেউ-বা আরও কোনও ভয়ংকরের করাল গ্রাসে প্রাণ দিয়েছে।
ড. ট্রাস্ক, যিনি আমাদের দলের মধ্যে নৃতত্ত্ববিদ ছিলেন– ঝুঁকে পড়ে কিছু করোটি তুলে নিলেন ভালোভাবে নিরীক্ষণের জন্য। করোটিগুলির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য তাঁকে হতবাক করে দিল। এ যে পিন্টডাউন মানুষের (বানর থেকে মানুষে অভিযোজনের মিসিং লিংক এই পিল্টডাউন ম্যান) চেয়েও পুরাতন করোটি, কিন্তু হাড়ের সমুদ্রের মধ্যে অধিকাংশই মানবকঙ্কাল। অনেক কঙ্কালের বৈশিষ্ট্য দেখে বোঝা গেল, তারা কিছুটা উন্নত শ্রেণির মানুষ। তা ছাড়া অতি উন্নত শ্রেণির মানুষের কিছু কঙ্কালও খুঁজে পাওয়া গেল। এদের অধিকাংশ হাড়ই চিবোনো, ছিবড়ে করে ফেলা। হয় কোনও ছোট প্রাণীর দ্বারা, আর না হলে মানুষের মতো দেখতে এমন কোনও মনুষ্যেতর প্রাণীর দ্বারা। অনেক ইঁদুরের হাড়গোড়ও এদের মধ্যে মিশে রয়েছে দেখা গেল। হয়তো এরা সেই প্রাণঘাতী মূষিকবাহিনীর হতভাগ্য সদস্যরা, যাদের মৃত্যু এ প্রাচীন পৈশাচিক মহাকাব্যের ওপর যবনিকা টেনে দিয়েছে।
এইসব দৃশ্য দেখার পর মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ভাষায় বা অনুভূতিতে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, কী অবিশ্বাস্যরকম জান্তব, পৈশাচিক, ঘৃণ্য, বিকৃত বর্বরতার চূড়ান্ত রূপ দেখেছিলাম আমরা সাতজন সেই আলো-আঁধারি ভূগর্ভস্থ গুহার সামনে। প্রতিটা মুহূর্তেই কিছু-না-কিছু আবিষ্কৃত হচ্ছিল আর সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে সাজাতে চেষ্টা করছিলাম, কয়েকশো বছর আগে, বা হাজার বছর পূর্বে না না, দু-হাজার বছর, তা-ও হয়তো নয় দশ হাজার বছর আগে এখানে ঠিক কী ঘটেছিল। এটা যেন নরকের গর্ভগৃহ, যা মৃত্যুর গন্ধে ম-ম করছে।
এসব কিছু মাঝে থ্রনটনের জ্ঞান এসেছিল বটে, কিন্তু ড. ট্রাস্ক যখন তাঁকে শোনালেন যে, স্থূপের কিছু কঙ্কালের নমুনা হাজার-দু-হাজার বছর পুরোনো চতুষ্পদের নমুনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, ভয়ে তাঁর আবার দাঁতকপাটি লাগল।
স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষগুলো পরীক্ষা করে আমাদের আতঙ্ক যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। বুঝলাম, চতুষ্পদ জীবগুলির মধ্যে দ্বিপদ প্রাণীরাও পাথরের বড় বড় ঘরের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকত। জেগে ওঠার পর হয় তারা ক্ষুধায় প্রাণত্যাগ করত বা মূষিক-আতঙ্কে মারা পড়ত। পরীক্ষা করে বোঝা গেল, এই জায়গায় চতুষ্পদ প্রাণীদের একটা পুরো পাল ছিল তাদের খাওয়ানোর জন্য প্রচুর শাকসবজি রাখা থাকত পাথরের একটা বিশাল কোটরে। সেইসব জাবনার অবশিষ্টাংশ এখনও সেখানে পাওয়া গেল। সেই পাথরের তৈরি বিশাল পাত্রটিরই বয়স আন্দাজে হিসেব কষে দেখা গেল রোমান সাম্রাজ্যের থেকেও বেশি! এখন বুঝলাম, আমাদের পূর্বপুরুষরা বাড়ির সামনে বিরাট শাকসবজির বাগান কাদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য বাজিয়েছিলেন।
রোমান স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্যার উইলিয়াম। তিনি টর্চ হাতে দেওয়ালে খোদাই-করা লিপি থেকে পাঠ করলেন এমন এক গুপ্তবিদ্যার পদ্ধতি, যা আমি আগে কোনও দিন শুনিনি। খ্রিস্টপূর্বোক্ত যুগের কিছু ধর্মবিশ্বাস এবং খাদ্যভ্যাসের বিবরণ পড়ে শোনালেন তিনি, যার সঙ্গে পরবর্তীকালে দেবী সিবেলের পুরোহিতরা নিজেদের কিছু উপাদানও মিশিয়ে দেন। ক্যাপটেন নরিস, যে একদা যুদ্ধক্ষেত্রের ট্রেঞ্চে বীরের মতো চলাফেরা করেছে, ইংরেজ স্থাপত্যের অংশটি দেখে এসে ভয়ে আর বিস্ময়ে জবুথবু হয়ে বসে পড়েছিল। ঘরের মতো অংশটির মধ্যে যুগপৎ কসাইখানা এবং রান্নাঘর দেখতে পেয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সে৷ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা প্রাচীন ইংরেজ নিদর্শন ছাড়াও দেওয়ালে খোদাই-করা প্রচুর শিল্পরীতি তার কাছে বেশ পরিচিত লেগিয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম, এ সব কিছুর বয়সই ১৬১০ সালের কাছাকাছি। ওখানে ঢোকার প্রবৃত্তি হল না আমার কারণ আমি জানতাম, ওই বাড়ির শয়তানি কার্যকলাপ আমার প্রপিতামহ ওয়াল্টার ডেলাপোরের ছুরিকাঘাতে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।