অগাস্টের সাত তারিখ নাগাদ আমরা এক্সাম প্রায়োরিতে পৌঁছোলাম। ভৃত্যেরা জানাল, এ ক-দিনে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। কালো মানিক সমেত আমার বাকি পোষ্য মার্জারশ্রেণি বিলকুল ঠান্ডা হয়ে ছিল। ইঁদুর-ধরা কলের একটা স্প্রিংও বাঁকা হয়নি। ঠিক হল, পরের দিন থেকেই অনুসন্ধান শুরু হবে। আমার অতিথিদের বসবাসের জন্য সব থেকে ভালো ঘরগুলোর ব্যবস্থা করা হল। সব মিটিয়ে, আমার ক্লান্ত শরীরটাকে কোনওমতে টেনে বিছানায় ফেললাম। কালো মানিক অভ্যাসমতো পায়ের কাছটিতে শুয়ে রইল।
শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরমুহূর্তেই সেই বীভৎস দুঃস্বপ্নের করাল ছায়া আমায় নিমেষে গ্রাস করল। স্বপ্নে রোমানদের এক ভোজসভার দৃশ্য দেখতে পেলাম– খাবারের প্রাচুর্যে ভরপুর সেই ভোজসভা। কিন্তু প্রতিটি প্লেট ঢাকা দেওয়া যেন কী এক অজানা আতঙ্ক সেইসব ঢাকা-দেওয়া প্লেটের ভেতরে লুকিয়ে আছে। তারপর আবার সেই জঘন্য স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটল। সেই শুয়োরের পাল ঘষটাতে ঘষটাতে আলো আঁধারিতে মোড়া আবর্জনাময় গুহার অন্ধকারে প্রবেশ করল। এসব দেখে যখন আমি চরম অস্বস্তি নিয়ে জেগে উঠলাম, দেখি চারদিকে ফটফটে দিনের আলো। আশপাশে পরিবেশের স্বাভাবিক শব্দ– কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। ইঁদুর বা বেড়াল কেউই উৎপাত করছে না। কালো মানিক পায়ের কাছে ঘুমিয়ে কাদা।
ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলাম। চতুর্দিকে নিবিড় নিস্তব্ধতা। আমার এই অনুসন্ধানদলের এক বিজ্ঞানী তিনি আবার কিছুটা অধ্যাত্মবাদীও বটে– আমাকে বলেছিলেন, এই বাড়িতে নাকি কিছু মহা-অশুভশক্তি রয়েছে। এই শক্তির প্রভাবেই নাকি আমি এসব উলটোপালটা ব্যাপার প্রত্যক্ষ করছি।
সবাইকে ঘুম থেকে তুলে প্রাতরাশ খেয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। তারপর আমাদের সাতজনের দলটা হাতে বড় বড় টর্চলাইট এবং খোঁড়াখুঁড়ির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সমেত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে চললাম। সেই রোমান স্থাপত্যে ঠাসা চোরাকুঠুরিতে পৌঁছে কাঠের দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দেওয়া গেল। কালো মানিক আমাদের সঙ্গেই ছিল। অনুসন্ধানকারীরা তাকে না নিয়ে যাওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পাননি, তা ছাড়া তার আচরণও আপাতত স্বাভাবিক। কুঠুরির দেওয়ালে রোমানদের শিলালিপি এবং আরাধনা বেদির নানা বৈচিত্র্যময় নকশা খুব সামান্য সময়ের জন্য দেখেই তাঁরা ঘরের কেন্দ্রস্থলে থাকা পাথরের মূল বেদির দিকে অগ্রসর হলেন। দলের দু-একজন প্রত্নবিজ্ঞানী এই অট্টালিকাতে আগে এসে থাকার সুবাদে রোমান শিলালিপির বিষয়ে তাঁরা আগেই পরিচিত ছিলেন। তাই সেসব বাদ দিয়ে সবার আকর্ষণের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠল ঘরের মাঝের সেই রহস্যময় পাথরের খণ্ডটি।
অনেক কায়দাকানুনের পর, স্যার ব্র্যান্টন বেদির পাথরটাকে পেছনে হেলাতে সক্ষম হলেন। যথেষ্ট মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসা সত্ত্বেও, সেই রন্ধ্রপথের গহিন কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে আমাদের শ্বাসরোধ হয়ে আসার উপক্রম হল। চৌকো করে কাটা সেই সুড়ঙ্গপথের মুখের কাছে পাথরের সিঁড়ি এঁকেবেঁকে নেমে গেছে অজানা কোন অন্ধকারে। আর সেই সিঁড়ির ধাপে ধাপে একটা বিশাল স্কুপের মতো বীভৎস নরকঙ্কাল বা মানুষের মতো কিছুর হাড়গোড়ের রাশি ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে যেগুলোকে মানুষের বলে চিহ্নিত করা গেল, সেগুলো বাদে বাকি বিভিন্ন রকমের খুলির উপস্থিতিও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাদের মধ্যে অতি প্রাচীনকালের মানুষের মাথার খুলিও যেমন আছে, তেমনি আছে বামন গোত্রের মানুষের করোটি। তা ছাড়া ইঁদুরে খাওয়া মনুষ্যশরীরের কঙ্কালময় ভুক্তাবশেষও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে চারপাশে। সিঁড়ির ধাপগুলো দেখেই বোঝা গেল, কেউ পাথর কেটে মসৃণ করে সেগুলিকে তৈরি করেছে, আর সেই ধাপের পাশে দেওয়ালের খাঁজ দিয়ে বয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাসের স্রোত।
আশ্চর্য হয়ে অনুভব করলাম এই বাতাস বহুকালের সুড়ঙ্গ খুলে বেরিয়ে-আসা বিষাক্ত বা কটু বাতাস নয়। এ বাতাস তাজা, ফুরফুরে। আমরা বেশিক্ষণ সেখানে অপেক্ষা না করে দুরুদুরু বুকে সেই সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামতে থাকলাম। স্যার উইলিয়াম সুড়ঙ্গের পাশের দেওয়ালের গায়ে কাটা খাঁজগুলো পরীক্ষা করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিলেন। আর তখনই তিনি হাড়-হিম-করা আবিষ্কারটি করলেন। ওঁর অস্ফুট স্বর স্বগতোক্তির মতো ভেসে এল– ছেনি বা পাথর কাটার যন্ত্রের ঘা দেখে মনে হচ্ছে, এই সুড়ঙ্গ ওপর থেকে নীচের দিকে কাটা হয়নি। বরং কেউ বা কারা এটা নীচ থেকে কাটতে কাটতে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে এসেছে।
ছড়িয়ে-থাকা হাড়গোড় এবং করোটির স্তূপ সরিয়ে কিছুটা নামার পর দূর থেকে একটা আলোর ক্ষীণ রেখা দেখতে পাওয়া গেল। টিমটিমে কোনও মায়াবী আলোর বিচ্ছুরণ নয়– এ রীতিমতো সূর্যের আলো যা কেবল প্রায়োরির পশ্চিমের উপত্যকার দিকে মুখ করে থাকা উঁচু বাঁধের কোনও অজ্ঞাত ফাটল দিয়েই আসা সম্ভব। কিন্তু সারা বাড়ি সংস্কার করার সময়ও এই ফাটলটা চোখে পড়ল না, এটা বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার। তবে ওই পশ্চিম উপত্যকাতে শুধু মানুষ থাকে না তা-ই নয়, উঁচু বাঁধটাও এমন লম্বা এবং খাড়াই যে, বেলুনে চড়েই কেবলমাত্র ওর ওপর উঠে পরীক্ষা করা সম্ভব।