যতক্ষণে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণভাবে নরিসকে আমার শোনা আওয়াজের কথা এবং বেড়ালদের আচরণের সম্ভাব্য কারণ বোঝাতে চেষ্টা করছি, দেওয়ালের মধ্যে ইঁদুরদের চলাচলের আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল। শব্দের তীব্রতা ধীরে ধীরে নিম্নগামী হয়ে অর্থাৎ এই কুঠুরির থেকেও আরও গভীরে, হয়তো-বা পাতালে প্রবেশ করল। মনে হতে লাগল, এই পুরো বাড়িটার ভিতের নীচে অতল গভীরে ঘিনঘিনে ইঁদুরের দল চরম আক্রোশে খলবল করে বেড়াচ্ছে।
নরিসকে যতটা অবিশ্বাসী ভেবেছিলাম, বাস্তবে দেখলাম সে ততটা নয়। আমার ব্যাখ্যা মন দিয়ে শুনে যে যেন কিছুটা চমকেই গেল। আমাকে আঙুল তুলে দেখাল, যে দরজার বাইরে বেড়ালদের তর্জনগর্জন অন্তর্হিত হলেও, কালো মানিকের উত্তেজনা তিলমাত্র কমেনি। সে একইভাবে এখনও আঁচড়ে চলেছে ঘরের মাঝের সেই পাথরের বেদির নীচের অংশটা।
ঠিক এই মুহূর্তে কী এক অজানা আতঙ্কের প্রতি অব্যক্ত ভয়ে আমি অবশ হয়ে গেলাম। যেন কিছু একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটেছে। ক্যাপটেন নরিসের দিকে তাকালাম আশ্চর্যজনকভাবে ক্যাপটেনের মতো হাট্টাকাট্টা, সাহসী, প্রাণোচ্ছল এবং চটপটে যুবকের মধ্যেও আমার আতঙ্কের অনুভূতি সঞ্চারিত হয়ে পড়েছে। হতে পারে, অট্টালিকাকে জড়িয়ে এইসব গেঁয়ো প্রবাদ এবং ভয়াল কিংবদন্তির প্রভাব হয়তো এত দিনে ফলতে শুরু করেছে তার ওপর। আমরা নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কালো মানিক সমানে সেই বেদির তলদেশ আঁচড়ে চলেছে, এবং মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিউ মিউ শব্দ করছে। সাধারণত, যখন সে আমার থেকে সাহায্য চায়, তখনই এরকম আচরণ করে থাকে।
নরিস এবার লন্ঠনটা তুলে নিয়ে বেদির ঠিক সেই অংশটার দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে কালো মানিক তার থাবা দিয়ে কিছু একটা খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করছে। হাঁটু মুড়ে বসে, পাথরের বেদি এবং মেঝের সংযোগস্থলে পড়ে-থাকা কিছু টুকরো ভগ্নাবশেষ সরিয়ে ফেলে, সেখানে আলো ফেলে তার চারপাশ পরীক্ষা করেও নরিস কিছু দেখতে পেল না। আলোটা ঘুরিয়ে সে ফিরেই আসছিল। আচমকা আমি এমন কিছু দেখতে পেলাম, যাতে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। নরিসকে আমি ব্যাপারটা দেখালাম, এবং দু-জনেই সেই অস্পষ্ট কিন্তু অপূর্ব আবিষ্কারের উত্তেজনায় স্থিরদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। লণ্ঠনটা বেদির যেখানে বসানো ছিল, সেখানে তার শিখাটা যেন মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছিল কীসের এক তাড়নায়। ভালো করে দেখে বোঝা গেল, বেদির কোনও এক ফাঁকফোকর দিয়ে হাওয়া বেরোচ্ছে, আর সেই হাওয়ার প্রকোপেই লণ্ঠনের শিখার এই অস্বাভাবিক আচরণ। হাওয়া বেরোচ্ছে বেদি এবং কুঠুরির মেঝের জোড়ের অংশটা থেকে, যেখানে এতক্ষণ নরিস বসে বসে আবর্জনা সরাচ্ছিল। তার মানে বেদির ঠিক নীচেই কোনও গুপ্ত কুঠুরি আছে, যা থেকে উদ্গত বাতাস পাথরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
বাকি রাতটা আমার বড়সড়ো স্টাডির উজ্জ্বল আলোতে বসে আলোচনা করেই কেটে গেল। আমাদের দুজনের মনেই প্রশ্ন– এবার কী কর্তব্য? আমরা এমন এক গুপ্ত কুঠুরি আবিষ্কার করে ফেলেছি, যা গত তিন শতকে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক খুঁজে পায়নি। এই প্রায়োরিতে প্রচুর মানুষ নিছক অ্যাকাডেমিক আগ্রহে এবং প্রত্নসন্ধানে এসেছিলেন বহু দিন ধরে। আমরা যে কুঠুরিতে আজ রাতে ছিলাম, সেটিকে এখানকার গভীরতম স্থান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এরও নীচে কিছু একটা আছে, সেটা জানার পরে আমাদের মতো অ-গবেষক মানুষও যেরকম উত্তেজিত হয়ে পড়েছি, তাতে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক যে উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাবেন, সেটা বলাই বাহুল্য।
এই ঘটনার পর দুটি সম্ভাবনা উদয় হল। এক, এই প্রায়োরি ছেড়ে চিরতরে পালিয়ে যাওয়া। এই অট্টালিকাকে জড়িয়ে যেসব গা-ছমছমে কুসংস্কার এবং প্রবাদ আছে, তাতে এরকম একটা গুপ্ত কুঠুরির কথা বলা আছে বটে। আর দুই, সাহসে ভর করে একটা রোমাঞ্চকর অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া দেখাই যাক-না আর কত গভীরে যাওয়া যেতে পারে, আর সেখানে কী রহস্যই বা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
সারারাত আলোচনা চালিয়ে, ভোরবেলা এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যে লন্ডনে ফিরে গিয়ে কয়েকজন প্রত্নতাত্ত্বিক এবং কিছু বিজ্ঞানীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা যাক। তাতে অন্তত এই ঐতিহাসিক আবিষ্কার স্বীকৃতি পাবে। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গুপ্ত কুঠুরির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা দু-জনে সে দিন ওই পাথরের বেদিটাকে সরানোর বহু বিফল প্রচেষ্টা করেছিলাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, ওই বেদিটাই হল কোনও অজানা গভীরতায়, বিপুল রহস্যময় এক দুনিয়াতে প্রবেশের একমাত্র পথ।
লন্ডনে গিয়ে আমি আর ক্যাপটেন নরিস আমাদের প্রাপ্ত প্রমাণ, মায় প্রায়োরির ইতিহাসের দলিল, তাকে ঘিরে গল্পকথা, প্রবাদ, কিংবদন্তি– সব কিছুই পাঁচজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, বিজ্ঞানবিদের সামনে উপস্থিত করলাম। এমন পাঁচজন, যাঁদের আমাদের পরিবারের গুপ্তকথা বিশ্বাস করে বলা যায়, এবং এঁরা এসব ব্যাপারে আগ্রহ নিয়ে অনুসন্ধানকাজও চালিয়ে থাকেন।
দেখলাম, এঁরা ব্যাপারটাতে বেশ আগ্রহী। হেসে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা কারও ভেতরেই বিশেষ দেখা গেল না, বরং বেশ সমানুভূতি নিয়েই এঁরা আমাদের কথাগুলো শুনলেন। এঁদের সবার নামোল্লখ প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু তবু বিশেষ করে স্যার উইলিয়াম ব্রিন্টনের নাম না নিলে অবিচার করা হবে। ইনি তত দিনে ট্রোড উপদ্বীপে (তুর্কি দেশের অন্তর্গত) খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়ে বেশ নাম কিনেছেন। এঁরা সকলেই আমাদের সঙ্গে প্রায়োরিতে গিয়ে খননকার্য চালাতে রাজি হলেন। ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করে যেদিন সবাই মিলে অ্যানচেস্টারের ট্রেনে চেপে বসলাম। সে দিন মনটা যেন কেমন এক অশুভ ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তার ওপর শুনলাম, দুনিয়ার অপর প্রান্তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে খুন হয়েছেন। খবরটা আমার চারপাশের আবহাওয়াকে আরও বিষণ্ণ করে তুলে এক অশুভ পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করতে লাগল। কেন জানি মনে হতে লাগল, এ যাত্রা মোটেই সুখকর হবে না।