হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে, আমি যে স্বপ্নগুলো দেখতাম, সেগুলো নরকযন্ত্রণার থেকে কিছু কম ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আমার স্বপ্নের একটা ধারাবাহিক রেকর্ড রাখতে শুরু করি। বড়াই করব না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমার ওই রেকর্ড যে-কোনও মনোবিদ লুফে নিতেন অনায়াসে। খুব ধীরে ধীরে হলেও আমি আমার এই নরকযন্ত্রণা থেকে একটু হলেও বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। ১৯১৪ সালের পর থেকে আমার স্বপ্নের মধ্যে নানারকম পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এখন আমি স্বপ্নের মধ্যেই নানা জায়গায় অবাধে ভেসে বেড়াতে পারতাম। বেড়াতে বেড়াতে কোথাও দেখতে পেতাম অদ্ভুত পাথুরে বাড়ি, যেগুলোর ভেতরের চোরাপথ দিয়ে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় যাতায়াত করা যেত। আবার কোথাও দেখতে পেতাম ওইরকমই গা-ছমছমে বন্ধ-হওয়া চোরা দরজা। এ ছাড়াও বিভিন্ন খোপ-খোপ আঁকা দরজা, নানারকম অদ্ভুত আকারের বাসনপত্র, জটিল কারিগরিতে ভরা বিভিন্ন গুহা (যেগুলোর উদ্দেশ্য বুঝতাম না) দেখতে পেতাম।
কিন্তু সত্যিকারের ভয় কাকে বলে, সেটা টের পেলাম ১৯১৫ নাগাদ। এই সময় আমি আমার স্বপ্নে বিভিন্ন জ্যান্ত জিনিস দেখতে শুরু করলাম। শুধু দেখা বললে ভুল হবে, তাদের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি আমার চিন্তায় গেঁথে গেল। হ্যাঁ, ঠিকই আমি ইথদের কথাই বলছি। যদিও তখনও আমার মগজে ওইসব রাক্ষুসে বিল্ডিং আর রাস্তার স্মৃতি ভালোভাবেই ছিল। ওই পুরোনো পুঁথিগুলোতে ইথদের চেহারার বর্ণনা পড়ার পর যখন নিজের চোখের সামনে ওদের দেখলাম, আমার ভয় বহুগুণে বেড়ে গেল। ইথরা আমার চোখের সামনে যখন ভেসে উঠত, এক-একসময় মনে হত পুরো গায়েব, আবার ঠিক তার পরের মুহূর্তেই জেলির মতো থকথকে দশ ফুট লম্বা শরীর নিয়ে চলে যেত আর-এক জায়গায়। এদের শরীর থেকে তিন-চারখানা অংশ বেরিয়ে থাকত, যাদের মধ্যে দুটোকে দেখে আন্দাজ করতে পারতাম ওগুলো ওদের থাবা। তিন নম্বর অংশ থেকে আবার চারটে লাল শুড়ের মতো অংশ বেরিয়ে থাকত। চার নম্বর অংশের ব্যাস ছিল প্রায় দু-ফুট। আর এটা দেখতে অনেকটা হলদে গ্লোবের মতো। এটা থাকত ইথদের দেহের ঠিক মাঝখানে। সেখানে আবার তিনটে কালো কালো চোখ ছিল। তখন বুঝলাম ওই হলদে গ্লোবটা হল ওদের মাথা। মাথা থেকে আবার ছাইরঙা ফুলের মতো চারটে অংশ বেরিয়ে থাকত। এর দু-দিকেই আবার সবুজ রঙের অ্যান্টেনার মতো শুড় দেখা যেত।
এমনিতে দেখলে মনে হত এরা তেমন ক্ষতিকারক নয়, কিন্তু এদের কাজকর্ম দেখে আমি সত্যিই ভয় পেতাম। ওই পাথুরে কুঠুরির তাকে যেসব বই থাকত, সেগুলো এরা শুড় দিয়ে টেনে বের করে নিয়ে আসত বেদির মতো টেবিলে। কখনও আবার ওই সবুজরঙা অ্যান্টেনার মতো শুড় দিয়ে খুব যত্ন নিয়ে কী সব লিখত। আর কথা বলত ওই শুড়গুলো দিয়ে ক্লিক ক্লিক আওয়াজ করে। ইথদের পিঠে একটা ঝোলার মতো অংশ থাকত। যেভাবে এরা ঝড়ের গতিতে নিজেদের লেখাপড়ার কাজ চালাত, তাতে এদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ ছিল না। আমি নিজেকে স্বপ্নে যে আতঙ্কপুরীতে দেখতাম, তার সর্বত্র এরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াত। কখনও-বা মাটির নীচের ঘরে রাখা কিছু অতিকায় মেশিনে বিভিন্ন তথ্য জমা করত। এরা কী কী লিখত, সেগুলোও আস্তে আস্তে আমার চোখে ধরা পড়তে শুরু করে। অধিকাংশই ছিল ওই আঁকাবাঁকা হায়ারোগ্লিফিক লেখা, কখনও-বা একটু অন্যরকম সমাসবদ্ধ কিছু। খুব সম্ভবত ওরা নিজেরা নিজেদের জন্যই কোনও বিশেষ বর্ণমালা তৈরি করেছিল। তবে হ্যাঁ, যারা লিখত, বাকি ইথদের থেকে তাদের গতি ছিল একটু হলেও কম।
১৯১৫ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে এই ইথিয়ান কার্যকলাপ আমাকে রীতিমতো ভোগাতে শুরু করল। কারণ এত দিন আমি যা যা দেখেছি, সেগুলো ছিল কিছু স্বপ্ন, কিছু আমার কল্পনা। কিন্তু এখন আমি নিজেকে ইথিয়ান দুনিয়ারই অংশ হিসেবে অনুভব করতে লাগলাম। এর আগে হয়তো আমি আমার নীচের দিকে তাকিয়ে চলা বা আয়না থেকে দূরে থাকার কথা উল্লেখ করেছি। এই ইথিয়ান দুনিয়াতেও নিজেকে খুব স্বচ্ছন্দ লাগত, কারণ এখানে কোনও আয়না ছিল না।
কিন্তু এরপর এল সেই কালরাত্রি, যখন আমি টের পেলাম, আমার মুন্ডুও একটা বিরাট থকথকে ঘাড়ের মতো অংশের সঙ্গে আটকানো। আর তার ঠিক নীচেই রয়েছে দশ ফুট লম্বা, কুঁজো হয়ে-যাওয়া শঙ্কুর মতো একটা ধড়। যেটা থেকে বেরিয়ে এসেছে রংবেরঙের আঁশওয়ালা কিছু শুঁড়। সে দিন আমার চিৎকারে বোধহয় আর্কহ্যামের অর্ধেক লোক জেগে উঠেছিল।
এক সপ্তাহ পর থেকে এই দৃশ্যগুলো ঘন ঘন দেখতে শুরু করলাম আমার স্বপ্নে। এখন অবশ্য আমিও ওই রাক্ষুসে ইথদের মতোই আকারওয়ালা একজন। আমিও বাকি ইথদের মতোই সহজভাবে চলাফেরা করতাম। শুড় দিয়ে টেনে নিতাম বই, আবার বেদির মতো টেবিলে সবুজ গঁড় দিয়ে অনেক কিছু লিখে চলতাম। ঠিক কী কী লিখতাম আর পড়তাম, প্রথম প্রথম আমার খেয়াল থাকত না, তবে বারবার একই জিনিস দেখার ফলে বুঝেছিলাম, ভয়ংকর নানা বিষয়ের সঙ্গেও গোটা ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন জীবজগতের বিষয়ই আমার লেখাপড়ার মূল বিষয় ছিল। তবে একটা ভয়ংকর বিষয় আমার আলাদাভাবে মনে আছে। সেটা হল মানব-প্রজাতির সম্পূর্ণ অবলুপ্তির লক্ষ লক্ষ বছর পর এক অদ্ভুত আকারের বুদ্ধিমান প্রাণীর গোটা দুনিয়া শাসনের বর্ণনা।