ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল। দুপুরে জেগে উঠে ক্যাপটেনকে ফোন লাগালাম। তিনি আসার পর দুজনে মিলে সেই চোরাকুঠুরির ভেতরে ঢুকে খোঁজ চালালাম, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই পাওয়া গেল না। তবে রোমানদের আমলে তৈরি এই কুঠুরিতে দাঁড়িয়ে বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। ঝুঁকে-পড়া প্রতিটি খিলান, প্রতিটি থাম যেন সিজারের সময়কার বিশুদ্ধ এবং সর্বোত্তম রোমান স্থাপত্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে অটলভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। দেওয়ালে বেশ কিছু খোদিত লিপি প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে আগ্রহের বিষয়, যেমন– P.GETAE. PROP TEMP DONA 100 L. PRAEC VS. PONTIFI AT.Y.S …
অ্যাটিয়াসের নামটা পড়ে শিউরে উঠলাম। ল্যাটিন কবি ক্যাথুলুসের লেখা আমার পড়া ছিল, আর সেই সুবাদে আমি প্রাচ্য দেবদেবীদের বীভৎস পূজাপদ্ধতি একটু হলেও জানতাম। দেবী সিবেলের আরাধনার সঙ্গে এঁর বেশ কিছু মিল লক্ষণীয়। আমি এবং ক্যাপটেন নরিস মিলে লণ্ঠনের আলোয় খোদিত লিপি এবং ছবিগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম। অধিকাংশই প্রায় মুছে গেছে, কিন্তু ঘরের মাঝে পাথরের মসৃণ বেদি দেখে আন্দাজ করতে কষ্ট হল না, এটা নরবলি বা ওই জাতীয় কিছু দেব-উৎসর্গের জন্য ব্যবহার করা হত।
দেওয়ালগুলো পরীক্ষা করার সময় কিছু খোদাই-করা ছবি দেখেছিলাম। তাতে দৃশ্যমান সূর্যের বিচ্ছুরিত রশ্মি নিশ্চিতভাবেই রোমান ভাস্কর্য নয়। মনে হয়, রোমান পুরোহিতরা এসব জায়গা থেকে কিছু আরও প্রাচীন পূজাপদ্ধতি আয়ত্ত করেছিলেন। কিছু কিছু পাথরে বাদামি রঙের দাগ দেখে চমকে উঠলাম। ঘরের মাঝবরাবর পাথরের যে চওড়া বেদিটা রাখা ছিল, তার উপরিতল পরীক্ষা করে মনে হল, এর সঙ্গে আগুনের কিছু সম্পর্ক ছিল, কারণ তার ওপর কালো মোটা দাগ বেশ ঘন হয়ে ফুটে রয়েছে। হয়তো এখানে আগুনে দগ্ধ করে বলিদান দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল।
ঠিক করলাম, আমি আর নরিস আজ এখানেই রাত্রিযাপন করব, এই চোরাকুঠুরির মধ্যে বসেই। সোফা-টোফাগুলো নামিয়ে আনা হল। চাকরবাকরদের বলে দিলাম, রাত্রে যা ই ঘটুক, কেউ যেন কিছু না করে। কালো মানিক আমাদের সঙ্গেই থাকল। ঘরের বিশাল ওক কাঠের দরজাটা চেপে বন্ধ করে দিলাম– যদিও কাঠের মধ্যে এমন কিছু ছিদ্র করা ছিল, যা দিয়ে হাওয়া-বাতাস ঢুকতে পারে অবাধে। না হলে দমবন্ধ হয়ে মারা পড়াও বিচিত্র নয়। যা-ই হোক, সব কিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে আমরা একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে সোফাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
প্রায়োরির পেটের গভীরে, মাটির বেশ খানিকটা নীচে এই কুঠুরিটার অবস্থান। সেক্ষেত্রে হয়তো খলবলে ইঁদুরদের বাসস্থানের জন্য এটা একটা আদর্শ জায়গা হতে পারে, কিন্তু ঠিক কী কারণে ওরা সবাই এদিকেই ধেয়ে আসে, সেটা বলতে আমি অপারগ! বসে পাহারা দেওয়ার অবস্থায় যদিও জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, তবুও ঘুম ও জাগরণের মধ্যবর্তী এক স্বপ্নালু তন্দ্রাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম মাঝে মাঝেই। পায়ের ওপর দিয়ে বেড়ালের উত্তেজিত চলাফেরা আমার এই আচ্ছন্ন অবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিল। স্বপ্ন যেটা দেখছিলাম, সেটাও ছেঁড়া-ঘেঁড়া, কিন্তু এটাকেও আমার আগের রাতে দেখা ভয়ংকর স্বপ্নটারই জুড়িদার বলা যেতে পারে। সেই আলোছায়ায় মেশা গুহামুখ, সেই ঘৃণ্য, থকথকে ছত্রাকময় জীবগুলির নোংরার মধ্যে গড়াগড়ি দেওয়া। আমি যতই তাদের দেখতে থাকলাম, জীবগুলো যেন ততই কাছে আসতে থাকল– আর… আর… তাদের অবয়ব স্পষ্টতর হতে থাকল আমার কাছে। এতটাই, যে তাদের প্রতিটা অঙ্গ আমি আলাদা করে দেখতে পাচ্ছিলাম। খুব নিকটে একটা মূর্তিমান আতঙ্ককে দেখে এতটাই ভয়ে পেয়ে গেলাম, যে ঘুমের মধ্যেই প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠলাম। কালো মানিক চমকে উঠে দাঁড়াল আর ক্যাপটেন নরিস, যে কিনা এক ফোঁটাও ঘুমোয়নি, হো হো করে হেসে উঠল। কী ভয়ানক দৃশ্য যে আমি স্বপ্নে দেখেছি, সেটা জানলে হয়তো নরিস এরকম আচরণ করতে পারত না বা হয়তো এর থেকেও বেশি হাসত। কিন্তু এরপর বহুক্ষণ আমি আমার মধ্যে ছিলাম না– প্রচণ্ড ভয় মাঝে মাঝে মানুষের স্মৃতিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেয়। এসব ভাবতে ভাবতেই আবার কেমন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল।
ঘটনাটা শুরু হতেই নরিস আমাকে ঠেলে তুলল। ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, নরিস আমাকে হালকা হালকা ধাক্কা দিচ্ছে আর শোনাতে চাইছে বেড়ালগুলোর সমস্বরে গরগর আওয়াজ। কান পেতে শুনলাম, ভারী ওক কাঠের দরজার বাইরে বেড়ালদের গজরানি আর দরজার ওপর তাদের নখের আঁচড়। কালো মানিক দরজার বাইরে তাদের বন্ধুদের উপস্থিতি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে, পাথরের দেওয়ালগুলোর কাছে উত্তেজিত হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল বারংবার আর আমি শুনতে পেলাম দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে খলবল করতে থাকা ইঁদুরদের চলাফেরা করার আওয়াজ, যা গত রাতে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।
আতঙ্ক ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করতে শুরু করল– ব্যাখ্যার অতীত অতিপ্রাকৃত ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেলাম। এই উন্মত্ত মূষিকের দল নিশ্চিতভাবেই এই দেওয়ালের ভেতর দিয়েই চলাচল করছে– যেটাকে আমি এত দিন কঠিন চুনাপাথরে তৈরি বলেই জানতাম। সম্ভবত সতেরোশো বছরের মধ্যে এই দেওয়ালের ভেতরে চুঁইয়ে জল ঢুকে সেটাকে এমনভাবে ক্ষইয়ে দিয়েছে, যা দিয়ে পরবর্তীকালে এই ধেড়ে ইঁদুরের দল প্রবেশ করে, এবং বাকি এবড়োখেবড়ো অংশগুলো কেটে মসৃণ করে ভেতর দিয়ে চলাচলের দিব্যি রাস্তা বানিয়ে ফ্যালে। এই ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের মনকে বোঝানো সত্ত্বেও চারপাশের ভৌতিক আবহাওয়া কিন্তু একচুলও হালকা হল না। যদি এই মূষিকের দল সত্যি সত্যি দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করছে, তাহলে নরিস সেটা শুনতে পাচ্ছে না কেন? কেন কেবল আমার হতচ্ছাড়া কানেই ইঁদুর-দৌড়ের এই খড়বড়ে আওয়াজ শ্রুতিগোচর হচ্ছে? কেন নুরিস কেবল কালো মানিকের অদ্ভুত আচরণ এবং দরজার বাইরে বেড়ালদের ক্রমাগত গজরানিতে অবাক হয়ে গিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে? কেন সে এখনও বুঝে উঠতে পারছে না মার্জারকুলের এই নিশাচর উত্তেজনা ও আক্রোশের কারণ?