সকালে উঠে সব কটা চাকরকে জড়ো করে জেরা করতে লাগলাম তারা গত রাত্রে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে কি না। বাকি সবাই মাথা নেড়ে সরে পড়লেও, রাঁধুনি জানাল, তার ঘরের বেড়ালটা কিছু অদ্ভুত আচরণ করেছে কাল রাত্রে। বেড়ালটা ঘরের জানলায় কাঠের গোবরাটটার ওপর শুয়ে ছিল চুপচাপ। কিন্তু মধ্যরাতের কোনও একসময়ে তার গরগর আওয়াজে রাঁধুনির ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখতে পায়, বেড়ালটা খোলা দরজা দিয়ে তিরবেগে ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে।
দুপুরের দিকে আবার নরিসকে ডেকে পাঠালাম। ঘটনাটা শুনে নরিস এবার বেশ কৌতূহলী হয়ে পড়ল। খুব আহামরি কিছু না হলেও ব্যাপারটার মধ্যে একটা বিশেষত্ব যে আছে, সেটা নরিস স্বীকার করতে বাধ্য হল। কিন্তু ইঁদুরের উপস্থিতির ব্যাপারটা আমাদের দু-জনকেই বেশ ভাবিয়ে তুলল। ঠিক করা হল, ইঁদুর ধরার কল পাতা হবে বিশেষ কিছু জায়গায়। চাকরবাকরগুলোকে কল কেনার নির্দেশ দিয়ে দুপুরের দিকে একটু বেরোলাম।
সে রাতে বেশ ক্লান্ত থাকায় একটু তাড়াতাড়িই শুতে গেলাম। কিন্তু বিধি বাম। এমন মারাত্মক দুঃস্বপ্ন দেখলাম যে, আমার শরীর কেমন করতে লাগল। স্বপ্নে দেখলাম, আমি অনেক উঁচু থেকে নীচে এক আবছায়া গুহামুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। তবে গুহামুখটা বেশি গভীর না, আবর্জনায় ভরে উঠে তার গভীরতা খুব বড়জোর পায়ের গোড়ালি ডোবাতে পারে। সেই গুহামুখের সামনে দিয়ে এক অপদেবতার মতো অবয়ব কিছু থলথলে ফাঙ্গাসের মতো জিনিসকে চরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রাণীগুলো এতটাই বিশ্রী এবং ভয়ংকর যে, দেখেই আমার গা গুলিয়ে উঠল। এবার সেই অবয়ব হঠাৎ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা নেড়ে কিছু একটা ইশারা করতেই, কোথা থেকে স্রোতের মতো একপাল কালো কুচকুচে ইঁদুর বেরিয়ে এসে ওই সমস্ত জীব, মায় মানুষটাকে অবধি খেয়ে শেষ করে ফেলল।
এরকম একটা আতঙ্কের স্বপ্নদর্শনে ছেদ পড়ল, কারণ গত রাতের মতো কালো মানিকের উত্তেজিত ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সে বেশ ভয় পেয়েছে। তার সামনের পা দুটো আমার গোড়ালির ফাঁকে ঢুকিয়ে সে কান খাড়া করে বসে আছে দেওয়ালের দিকে চেয়ে। তবে আজ আর কষ্ট করে শব্দের উৎসের খোঁজ করতে হল না। ঘরের প্রতিটি দেওয়াল যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এক খলবলে শব্দে। লোলুপ বিশালকায় ইঁদুরের দলের হুড়মুড়িয়ে চলার আওয়াজে পূর্ণ হয়ে উঠেছে আমার ঘর। জানলা দিয়ে ঘরে আজ এক ফোঁটা আলোও ঢোকেনি যে, কালকের ছিঁড়ে-যাওয়া পর্দাটার দিকে তাকাতে পারব। আমি লাফিয়ে উঠে ঘরের ইলেকট্রিক আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম।
ঘর আলোকিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম, নতুন পর্দাটা বিপজ্জনকভাবে নড়ে চলেছে একটা নির্দিষ্ট দিকে। যেন ঢেউ খেলছে তার ওপর। কিন্তু পরমুহূর্তেই নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল– সঙ্গে সেই খলবলে শব্দটাও থেমে গেল নিমেষে। খাট থেকে নেমে আমি ফায়ারপ্লেসের শিকটা তুলে নিয়ে সন্তর্পণে পর্দার ওই অংশটাতে একটু খোঁচালাম, তারপর পর্দাটাকে একটু সরিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম ওর পেছনে আছেটা কী। পাথরের নিরেট দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। বেড়ালটাও এখন অনেক স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছিল। মনে হয়, অতিপ্রাকৃতের উপস্থিতির ভীতিটা সে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে এতক্ষণে। এবার আমি ইঁদুর ধরার কলগুলো ভালো করে পরীক্ষা করলাম, যেগুলো আমার ঘরে রাখা ছিল। প্রত্যেকটি কলের মুখ বন্ধ– তার মানে কিছু তো এদের মধ্যে দিয়ে গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তা অক্ষতভাবে কলের মারণ-ফাঁস উপেক্ষা করে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
আর ঘুমোনোর প্রশ্ন আসে না। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আমি গ্যালারি অতিক্রম করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমার স্টাডিতে বসা স্থির করলাম। কালো মানিকও আমার পায়ে পায়ে চলল। সিঁড়ির কাছে পৌঁছোনোর মুখেই সে আমাকে অতিক্রম করে একছুটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। কয়েক ধাপ নামার পরেই বুঝলাম, নীচের বড় ঘরে একটা কিছুর আওয়াজ হচ্ছে এমন একটা শব্দ, যা চিনতে ভুল হওয়ার নয়। দেওয়ালে লাগানো ওক কাঠের প্যানেলগুলো যেন চলমান হয়ে উঠেছে মূষিকদলের দ্রুত এবং খড়খড়ে চলাফেরার আওয়াজে। কালো মানিক ফোঁস ফোঁস করতে করতে এক দিশাহীন শিকারির মতো সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘরে ঢুকেই আমি আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম কিন্তু আশ্চর্য, এবারে আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শব্দ কিন্তু আগের বারের মতো থেমে গেল না। মূষিকদের প্রচণ্ড গতিতে চলাফেরা চলতেই থাকল। তবে অদৃশ্য এই ধাবমান মূষিকদল যে একটি নির্দিষ্ট দিকেই চলেছে, তার আন্দাজ পাওয়া গেল। বুঝলাম, এই সংখ্যায় অগণিত মূষিকশ্রেণি কোনও এক সুউচ্চ স্থান থেকে নীচের কোনও এক অকল্পনীয় গভীরতায় এক অজানার আকর্ষণে অবিশ্রান্ত গতিতে ছুটে চলেছে।
আচমকা হলঘরে পদশব্দ শোনা গেল, আর পরমুহূর্তেই দেখলাম, দু-জন ভৃত্য স্টাডির দরজা ঠেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের মতে, বাড়িতে এমন কিছু একটা ঘটছে, যার ফলে বাড়ির সমস্ত বেড়াল উন্মত্তের মতো ছোটাছুটি শুরু দিয়েছে। আর প্রত্যেকটি বেড়াল সিঁড়ির পর সিঁড়ি অতিক্রম করে বাড়ির একদম নীচে অবস্থিত চোরাকুঠুরির দরজার সামনে গিয়ে বসে চিৎকার করে কেঁদে চলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইঁদুরের খড়খড়ানি তারা শুনেছে কি না। কিন্তু তারা মাথা নেড়ে না বলল। আমি যখন ঘরের দেওয়ালের ভেতর ধাবমান মূষিকদলের শব্দ তাদের শোনাতে গেলাম, বুঝতে পারলাম, সেই আওয়াজ অনেকক্ষণ আগেই থেমে গিয়েছে। অগত্যা দুই ভৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেই চোরাকুঠুরি অভিমুখে রওনা দিলাম। যতক্ষণে সেখানে পৌঁছোলাম, মার্জারকুল সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। পরে অবশ্য এই কুঠুরির তত্ত্বতল্লাশ আমি করেছিলাম, কিন্তু এখন আপাতত এর আশপাশে ঘুরেই আমি ক্ষান্ত দিলাম। এই ঘরের চারপাশেও বেশ কিছু ইঁদুর ধরার কল পাতা ছিল দেখতে পেলাম, আর সেগুলোও যথারীতি বন্ধ। কলে আটকা-পড়া কোনও জীবের চিহ্নমাত্র নেই। তবে ইঁদুরদের উপস্থিতিটা যে আমি ছাড়া কেউ বুঝতে পারেনি, সেটা জেনে একটু নিশ্চিন্ত লাগছিল। নিজের স্টাডিতে ফিরে আরামকেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। এই বাড়ি এবং এই পূর্বতন বাসিন্দাদের ব্যাপারে যা কিছু পড়েছিলাম, যতরকম গল্প, লোককথা জেনেছিলাম– এক-এক করে মনে করার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।