২২ জুলাই থেকে আমার চারপাশেও এমন কিছু ঘটতে আরম্ভ করল, যা ঠিক স্বাভাবিক নয়। প্রথমে অত পাত্তা না দিলেও, এই ছোটখাটো ব্যাপারগুলিই পরে এমন কিছু ঘটনার সূত্রপাত ঘটাল, যেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে আমি অপারগ। ঘটনাটা যদিও খুবই অকিঞ্চিৎকর এতটাই যে, প্রায় নজরেই পড়ে না। এত বড় বাড়িতে একপাল চাকরবাকর সমেত আছি, বড় বড় পাথরের নতুন রং-করা দেওয়াল, নতুন কাঠের আসবাব, এক আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে বাস করছি। চাকরবাকররা সারাক্ষণ আমার খিদমত খাটার জন্য মুখিয়ে রয়েছে– এই পরিবেশে ভয়ডর বিশেষ লাগে না। তবুও মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, আমার বুড়ো বেড়ালটা যেন বিনা কারণে খুব উত্তেজিত এবং সতর্ক। কালো মানিকের মুড আমি খুব বুঝি, কিন্তু এ পরিবর্তনটার কোনও বিশেষ কারণ খুঁজে পেলাম না। সে সারা ঘরবাড়ি ছটফট করতে করতে ঘুরে বেড়াতে লাগল, আর বিশেষ করে পাথরের দেওয়ালগুলো, যেগুলো বাড়িটার স্থাপত্যে একটা গথিক চেহারা দিয়েছে সেগুলোকে শুঁকতে লাগল। বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা কীরকম একটা ক্লিশে হরর মুভির মতো শোনাচ্ছে। ওইসব সিনেমাতে সাধারণত একটা কুকুর থাকে, যে মনিবের সামনে থাকা অদৃশ্য কিছু দেখে চিৎকার করে ওঠে। আমার মার্জার-পর্বও অনেকটা সেরকমই লাগতে পারে, কিন্তু কী করব– ব্যাপারটা না বলেও থাকতে পারছি না।
পরের দিন এক চাকর এসে অভিযোগ জানাল যে, সব কটা বেড়ালই নাকি এরকম উত্তেজিত আচরণ করা শুরু করে দিয়েছে। আমার স্টাডিরুমটা বাড়ির দোতলায়। বাঁকানো খিলানের ছাদ, কালো ওক কাঠের কড়িবগা, বড় বড় পুরোনো আমলের গথিক জানলা– যা দিয়ে বাইরে তাকালে চুনাপাথরের টিলা আর পরিত্যক্ত উপত্যকাটিকে স্পষ্ট দেখা যায় –সব মিলিয়ে ঘরটির মধ্যে এক প্রাচীন আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে। এই ঘরে ঢুকে চাকরটি যতক্ষণ আমাকে মার্জারকুলের গত রাতের ছটফটানির কাহিনির বিবরণ দিচ্ছিল, আমি খেয়াল করলাম– কালো মানিক কাঠের কালো প্যানেলগুলোর কাছে গুটিশুটি মেরে বসে কী শুঁকছে, আর মাঝে মাঝে সেগুলোকে আঁচড়ে চলেছে। অট্টালিকার প্রাচীন পাথরের দেওয়ালের ওপর আস্তরণ হিসাবে জায়গায় জায়গায় কাঠের প্যানেলিং ব্যবহার করা হয়েছে। –কিন্তু কালো মানিকের তার ওপর এত আক্রোশ কেন? আমি চাকরটাকে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে, পুরোনো পাথরের স্তরে কিছু অদ্ভুত গন্ধ থাকে, কাঠের স্তর ভেদ করে যা হয়তো আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। কিন্তু কোনও কারণে তা মার্জারকুলের সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়েছে। আমার এই ব্যাখ্যা মনে হল, আমার ভৃত্যের ঠিক মনঃপূত হল না। সে চটপট বলে উঠল, আচ্ছা কত্তা, ইঁদুর বা ছুঁচোও তো থাকতে পারে? আমি হেসে ওকে জানালাম যে, গত তিনশো বছরে এই অট্টালিকাতে কোনও ইঁদুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বাইরে মেঠো ইঁদুর হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু কোনও পথভ্রষ্ট মেঠো ইঁদুরও এখানে কোনও দিন ঢুকেছে বলে জানা যায়নি। যা-ই হোক, সে দিন দুপুরে আমি ক্যাপটেন নরিসকে ডাকলাম। তিনি সোজা বলে দিলেন যে, মেঠো ইঁদুরের পক্ষে এত কম সময়ের মধ্যে সুবিশাল অট্টালিকাতে ঢুকে এর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া অসম্ভব।
সে দিন রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে বিশ্রামের আয়োজন করছিলাম। অট্টালিকার পশ্চিম মিনারের একটা ঘরে আমি থাকতাম। আমার স্টাডি থেকে শোয়ার ঘরে পৌঁছোনোর জন্য একটা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছোট গ্যালারির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সিঁড়িটা যদিও একই রকম আছে, তবে গ্যালারিটা পুরোপুরি সংস্কার করা হয়েছিল। আমার শোয়ার ঘরটি আকৃতিতে গোলাকার, এবং দেওয়ালে বেশ কারুকার্যময় পর্দা ঝোলানো। ঘরটা সাজাব বলে আমি নিজে পর্দাগুলো লন্ডন থেকে বেছে বেছে কিনে এনেছিলাম। এই ঘরের দেওয়ালগুলোতে সেই জন্য কাঠের প্যানেলিং রাখা হয়নি। যা-ই হোক, কালো মানিককে সঙ্গে করে শোবার ঘরে ঢুকে আমি বিরাট দরজাটায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম, আর দেওয়ালে মোমবাতিদানের মতো লাগানো ইলেকট্রিক আলো বন্ধ করে সুবিশাল পালঙ্কের নরম গদিতে ডুবে গেলাম। বাধ্য ভৃত্যের মতো কালো মানিক আমার পায়ের কাছটিতেই শুয়ে থাকল। তবে জানলার দিকের পর্দাটা পুরোপুরি টানলাম না। পর্দার ফাঁক দিয়ে রাতের কালো আকাশের এক অদ্ভুত ফ্যাকাশে আলো এসে আমাকে যেন আরও তন্দ্রাবিষ্ট করে তুলল। জানলার ওপরে চকমকি পাথরের কালো সিলয়েট সেই মায়াবী আলোয় একতাল জমাট অন্ধকারের মতো থম মেরে রইল।
বেশ ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্নের ঘোরেই বুঝতে পারলাম, বেড়ালটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছে। চোখ খুলে সেই আধো অন্ধকারে দেখতে পেলাম, কালো মানিক তার সামনের দুটি পা আমার গোড়ালির ওপর রেখে আর পেছনের পা দুটো টানটান করে ঘরের পশ্চিমদিকের দেওয়ালের দিকে সোজাভাবে তাকিয়ে রয়েছে। যদিও আমার চোখ কিছুই দেখতে পেল না, কিন্তু তবুও স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানি না মনে হল, কালো মানিকের উত্তেজনা অমূলক নয়। পর্দাটা কি একটু নড়ল? হতে পারে। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, পর্দার পেছনে একদল প্রাণীর চলে-ফিরে বেড়ানোর আওয়াজ অস্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম। ইঁদুর না ছুঁচো? কালো মানিক ততক্ষণে খাট থেকে এক লাফে নেমে পড়েছে, এবং সেই বিশেষ দিকের ঝোলানো পর্দার ওপর আক্রমণ শানিয়েছে। ওর শরীরের ভারে এবং দাঁতের টানে সাজানো পর্দা ছিঁড়ে নেমে এল মাটিতে, আর উন্মুক্ত হয়ে গেল পর্দার পেছনের স্যাঁতসেঁতে প্রাচীন পাথরের দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে এদিক ওদিক সংস্কারের ছাপ পাথরের দেওয়ালে কোনও ফাঁকফোকরও নেই। তাই ইঁদুর বা ছুঁচো এসে ঘরে ঢুকে পড়বে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু কালো মানিকের তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে চরম আক্রোশে কাঠের মেঝে আর পাথরের দেওয়ালের সংযোগস্থলে পা দিয়ে আঁচড়াতে থাকল, যেন ওখানে সে কিছুর সন্ধান পেয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ এরকম চলার পর, হতোদ্যম হয়ে ফিরে এসে আবার আমার পায়ের কাছে চুপটি করে শুয়ে পড়ল। আমি একই রকমভাবে শুয়ে শুয়ে সব দেখলাম– একচুলও নড়িনি। আমার বেড়ালটা ঘুমিয়ে পড়লেও সে রাত্রে আমার আর ঘুম এল না।