এতসব গল্পকথা, গ্রাম্য প্রবাদ, ভয়ানক ইতিহাসের সারি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বেশ কয়েকদিন। তবে এসবের মধ্যে দিয়েই দীর্ণ শতাব্দীপ্রাচীন আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটের এই ধ্বংসাবশেষের সংস্কারের কাজ প্রায় সমাপ্ত করে এনেছিলাম। শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসের অলৌকিক কর্মকাণ্ড আমার মনকে বিবশ করলেও– ক্যাপটেন নরিস এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ পুরাতত্ত্ববিদরা আমাকে প্রতিমুহূর্তে উৎসাহ জুগিয়েছিল এই প্রাচীন ইতিহাস পুনরুদ্ধারের কাজে। দু-বছরের ক্রমাগত পরিশ্রমের পর যখন কাজটা শেষ হল, তখন আমি প্রাণভরে পুরো বাড়িটা দেখলাম। খাঁজকাটা কাঠের দেওয়াল, ধনুকের মতো বাঁকা সিলিং, পাথরের গোবরাট-বসানো জানলা, চওড়া সিঁড়ি- সব মিলিয়ে এক প্রাচীন অভিজাত স্থাপত্যরীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নিজের পরিশ্রম এবং খরচকে সার্থক বলে মনে হল। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের প্রতিটা অংশে নিখুঁতভাবে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে ফেলা গেছে। যে জায়গাগুলো নতুনভাবে বানাতে হয়েছে, সেগুলোর স্থাপত্যও বেশ চমৎকারভাবে অট্টালিকার পুরোনো মেজাজের সঙ্গে খাপ খেয়ে গেছে। এবার আমার পরবর্তী কাজ হল নিজের পরিবারের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা। কারণ আমার পরিবারে শেষ পুরুষ বলতে কেবল আমিই অবশিষ্ট রয়েছি। এখানে বাস করে আমার বাপ-দাদাদের নামে যেসব অভিশাপ আর ঘৃণা ছড়িয়ে আছে সেগুলো ভুল প্রমাণিত করা এবং ডেলাপোর যে শয়তানের আর-এক নাম নয়, তা প্রতিষ্ঠা করাই আমার মূল কর্তব্য বলে ঠিক করলাম। আমার নিশ্চিন্ত হবার আরও বড় কারণ ছিল এই যে, যদিও বাইরের চাকচিক্যে এক্সাম প্রায়োরি সেই পুরোনো সময়কেই ধরে রেখেছে, তবুও তার ভেতরের অনেক কিছুরই খোলনলচে বদলে ফেলা হয়েছে, আধুনিক করে ফেলা হয়েছে এই প্রাচীন অট্টালিকার বেশ কিছু অংশ। তাই ভূত-টুত কিছু থাকলেও তারা এত দিনে পাততাড়ি গুটিয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
হ্যাঁ– যা দিয়ে শুরু করেছিলাম– ১৬ জুলাই ১৯২৩ সালে আমি প্রায়োরিতে পাকাপাকিভাবে উঠে এলাম। আমার এখন পরিবার বলতে, সাতটা চাকর আর ন-টা বেড়াল, যার মধ্যে শেষোক্তদের প্রতি আমার ভালোবাসা একটু বেশি। সবচেয়ে বয়স্ক বেড়ালটা, আমার আদরের কালো-মানিক আমার সঙ্গে সাত বছর ধরে রয়েছে সেই ম্যাসাচুসেটের বোলটন থেকে। আর, ক্যাপটেন নরিসের সঙ্গে এখানে এত দিন থাকার সুবাদে বাকি বেড়ালগুলোকে আমিই জোগাড় করেছিলাম।
দিন পাঁচেক একরকম শান্তিতেই কেটে গেল। নিজের পরিবারের ব্যাপারে তথ্যাদি নথিভুক্ত করতেই আমার দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হত। যে রাতের ভয়ানক ঘটনায় আমার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছিল, সেই বিশেষ রাতের ব্যাপারে বিশদে জানার জন্য আমার কৌতূহল ছিল অদম্য। সে ব্যাপারে আমি প্রচুর তথ্য নাড়াঘাঁটা করেছিলাম। এত নথি পড়ে মনে হল, যেন কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাপার আমি ধরতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস, এই ঘটনার কথাই লিখে সেই চিঠি মুখবন্দি খামে পুরে আমার দাদুকে রাখতে দিয়ে গিয়েছিলেন আমার প্রপিতামহ, যা কারফ্যাক্সে থাকার সময় ভস্মীভূত হয়ে যায়।
যা জানলাম, তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। আমার প্রপিতামহ নাকি নিজের হাতে, চারজন চাকরের সাহায্যে, পরিবারের বাকি সদস্যদের ঘুমের মধ্যেই হত্যা করেন। এই ঘটনার হপ্তা চারেক আগে তিনি নাকি এমন কিছু একটা আবিষ্কার করেন, যাতে তাঁর স্বাভাবিক চালচলনে আমূল পরিবর্তন আসে। তাঁর এই পরিবর্তন নাকি শুধু ওই চারজন চাকরের কাছেই তিনি নিজে প্রকাশ করেছিলেন। বাকিদের সামনে তিনি স্বাভাবিক আচরণই করে বেড়াতেন। হতে পারে, এই কারণেই চাকরগুলো রক্ষা পায়, এবং সেই ঘটনার পরদিন থেকে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি যেন তারা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। এই সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের বলি হয়েছিল এক বাবা, তিন ভাই এবং দুই বোন– যাদের গ্রামবাসীরা খুব একটা সুবিধের চোখে কোনও দিনই দেখত না। এবং হতে পারে, সে কারণেই আইনের ফাঁস আমার প্রপিতামহের ওপর সেভাবে চেপে বসতে পারেনি, বা ইচ্ছে করেই হয়তো বসেনি। বিচার এমনভাবেই হয়েছিল, যাতে এই হত্যাকারী নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে এবং দিনের আলোয় এই অভিশপ্ত ভিলা ছেড়ে ভার্জিনিয়ায় পালিয়ে যেতে পারে। কানাঘুষো এমন পর্যায়ে চলেছিল যে, তিনি নাকি এই জায়গাটিকে সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে-আসা এক নারকীয় অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছিলেন। আমার প্রপিতামহ এমন কী আবিষ্কার করেছিলেন, যা তাঁকে ঠান্ডা মাথায় এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড করতে প্রলুব্ধ করল, সেটা আমি কিছুতেই ভেবে পেলুম না। ওয়াল্টার ডেলাপোর তো এই পরিবারেরই মানুষ ছিলেন, এবং নিজের পরিবারের ব্যাপারে কানাঘুষো, জনশ্রুতি, লোককথা সবই ওঁর অবগত ছিল। তাই সেসব গল্পকথা বা ভয়ানক ঘটনার বিবরণ তাঁর ওপর হঠাৎ এতটা প্রভাব নিশ্চয়ই ফেলেনি, যার প্ররোচনায় তিনি নিজের পরিবারকে হত্যার মতো এরকম বীভৎস পদক্ষেপ নেবেন। তাহলে তিনি কি কিছু দেখে ফেলেছিলেন- কিছু প্রাচীন রীতিনীতি? যা ভয়ানক গোপন কিন্তু সাংঘাতিক? নাকি কিছু গোপন সংকেত রহস্য উদ্ধার করেছিলেন, যার থেকে বেরিয়ে পড়েছিল কোনও ভয়ংকর পৈশাচিক সত্য? ওয়াল্টার কিন্তু তাঁর নরম স্বভাব এবং মৃদুভাষ্যের জন্য পরিচিত ছিলেন সারাজীবন। ভার্জিনিয়াতে যখন ছিলেন, তখনও চুপচাপ এবং শান্তিপ্রিয়ই ছিলেন। কিন্তু এমন কী ঘটে থাকতে পারে তাঁর সঙ্গে, যে এই শান্ত স্বভাবের মানুষ হঠাৎ রক্তপিপাসু জল্লাদ হয়ে উঠে এহেন নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করলেন?