এর পূর্বে আমাদের পরিবারের ওপর কোনও অশুভ অপচ্ছায়ার প্রাদুর্ভাবের খবর জানা যায় না, কিন্তু এখানে আসবার পর থেকেই অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছিল। ১৩০৭ সালের আর-একটা লেখায় দেখতে পেলাম, জনৈক ডেলাপোরকে ঈশ্বরের অভিশাপ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রাম্য প্রবাদ এবং জনশ্রুতিতে সেই পুরোনো মন্দিরের ভগ্ন্যুপের ওপর গড়ে-ওঠা এই অট্টালিকাকে চূড়ান্ত অশুভ এবং শয়তানের স্থান আখ্যা দেওয়া হয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত গল্পগুলি তো আরও ভয়ানক প্রতিটি জনশ্রুতি মোটমাট ভয়ংকর সব বর্ণনায় পরিপূর্ণ। ভয়ের নানা রূপের প্রকাশ সেসব গল্পে প্রকটভাবে বিদ্যমান, কিন্তু এই বিপুল আতঙ্কের কারণ হিসাবে কোথাও সেরকম কিছু লেখা নেই। ঠিক কী যুক্তিতে এতগুলো মানুষ এত বছর ধরে ভয়ে, আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে এই স্থানকে পরিত্যাগ করে চরম ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল, তা নিশ্চিতভাবে কোথাও খুঁজে পেলাম না। উলটে আমাদের পূর্বপুরুষদের, বলা ভালো, আমার আদি পরিবারকে এমন পৈশাচিক আতঙ্ক এবং ঘৃণার পাত্র হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, যার বর্ণনার তুলনায় গিলস দ্য রেটজ বা মাকুইস দ্য সাদের মতো অত্যাচারী শাসকের নিষ্ঠুরতার বিবরণও নেহাতই ছেলেভুলোনো বলে মনে হতে পারে। গ্রামের কিছু মানুষের হঠাৎ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের পরিবারকেই দায়ী করা হয়েছে সর্বতোভাবে।
ব্যারন আর তাদের ছেলেপুলেরাও কিছু কম রহস্যময় ছিলেন না। কানাঘুষো শোনা যায় যে, এই ব্যারন নির্বাচনেও নাকি এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটত। উত্তরাধিকাররা যদি যোগ্য না হত তাহলে তারা নাকি কোনও অজ্ঞাত কারণে অপঘাতে মৃত্যুবরণ করত– যাতে পরের বিশেষ গুণাবলিসম্পন্ন যোগ্য সন্তান ব্যারন-এর সেই জায়গাটি নিতে পারে। এটা কীরকম যেন এক পারিবারিক রীতিতে পরিণত হয়েছিল যা পরিচালিত হত পরিবারের তৎকালীন যিনি মাথা থাকতেন, তাঁর অধীনে। এখানে বংশপরম্পরাগতভাবে উত্তরপুরুষ নির্বাচনের থেকে লোকটির মেজাজ এবং তার উৎকট আচার-আচরণ বেশি প্রাধান্য পেত। যে সমস্ত পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হত, তারাও এই অদ্ভুত প্রথার অঙ্গ হয়ে যেত। কনওয়েলের লেডি মার্গারেট ট্রেভর, যিনি কিনা পঞ্চম ব্যারনের দ্বিতীয় সন্তানের স্ত্রী ছিলেন, তিনি তো বহু দিন এই অঞ্চলে শিশুদের ত্রাস বলে পরিচিত ছিলেন। ওয়েলস সীমানার কাছে এখনও তাঁর নামে এক লোকগাথা আছে– কী ভয়ানক তার কথাগুলি, পড়লেই বুকের মধ্যে কেমন যেন শিরশিরানি জাগে। এরকম আরও এক চরিত্র ছিলেন, লেডি ম্যারি ডেলাপোর। তিনিও নাকি সমান কুখ্যাত ছিলেন কিন্তু আর্ল অব শ্রেউসফিল্ডের সঙ্গে বিবাহের কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি খুন হন। খুনের দায়ে তাঁর স্বামী এবং শাশুড়ি নাকি গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু চার্চে গিয়ে প্রধান পাদরির কাছে তাঁরা নাকি নিজেদের দোষ স্বীকার করে পুরো ঘটনা খুলে বলেছিলেন। এই ঘটনার অনতিবিলম্বেই তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং পুরো বিষয়টা এমনভাবে চেপে যাওয়া হয়, যাতে কাকপক্ষীও না জানতে পারে।
এই লোককথা এবং জনশ্রুতিগুলো, বলাই বাহুল্য, আমাকে বিলক্ষণ বিচলিত করেছিল। নানা বই, খবরের কাগজ, পুথির পাতায় পাতায় এইসব ভয়ানক ঘটনার পুনরাবৃত্তি, বারংবার আমার বিভিন্ন পূর্বপুরুষের নাম জড়িয়ে আতঙ্কের এক আবহাওয়া সৃষ্টি হওয়া– আমার খুবই বিরক্তিকর লেগিয়েছিল। এইসব আধিভৌতিক ঘটনাপরম্পরার চলচ্ছবি পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে গেল আমার খুড়তুতো দাদা র্যাডলফ ডেলাপোরের কথা। আমরা যখন কারফ্যাক্সে থাকতাম, তখন র্যাডলফ নিগ্রোদের সঙ্গে ভীষণভাবে মেলামেশা শুরু করেছিল। শুনেছিলাম, পরবর্তীকালে মেক্সিকান যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর সে নাকি কালাজাদু চর্চা করে এক ভুডু বিশারদ হয়ে উঠেছিল।
যা-ই হোক, এক্সাম প্রায়োরির লাগোয়া যে চুনাপাথরের উঁচু দেওয়ালটা রয়েছে, তার অপর পাড় থেকে শুরু হয়েছে এক বিস্তীর্ণ উপত্যকা– সে কথা আমি আগেও বলেছি। এই উপত্যকাকে নিয়ে এক অদ্ভুত গল্প পড়লাম। উপত্যকার কাছেই যে কবরস্থান আছে, বসন্তের ঝিরঝিরে বৃষ্টির একরাতে স্যার জন ক্লেভের ঘোড়া অদ্ভুত সাদা কিছু একটাকে মাড়িয়ে ফ্যালে– আর সেই জিনিসটার তীক্ষ্ণ চিঙ্কারে সচকিত হয়ে, ক্লেভের চাকর প্রায়োরির দিকে মুখ তুলে চেয়ে ছিল। চাঁদনি রাতের মায়াবী জ্যোৎস্নাতে সে প্রায়োরিতে এমন কিছু দেখেছিল, যাতে সে আতঙ্কে পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যায়। তবে এসব গাঁজাখুরি গল্প হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এটাকে আমার চোখের ভুল ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। রাতের বেলায় কবরস্থানে দাঁড়িয়ে এসব ভুল দেখা অস্বাভাবিক কিছু না। যদিও আমি সেই সময়ে ভীষণ সন্দেহবাদী ছিলাম। গ্রামের চাষিদের মাঝে মাঝে হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়াটা যদিও সন্দেহজনক, তবুও মধ্যযুগীয় সামাজিক পরিবেশে এসব খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। তবে এ জিনিসটা খুব অস্বস্তিকর যে, এক্সাম প্রায়োরির বাইরে সুবিশাল পাঁচিলের এদিক ওদিকে বল্লমের ফলায় মানুষের কাটা মুণ্ডু টাঙিয়ে রাখা হত– কেবল বোঝানোর জন্য যে, অতিরিক্ত কৌতূহলের অর্থ মৃত্যু।
এই গল্পগুচ্ছের মধ্যে এমন বেশ কিছু গল্প ছিল, যেগুলো কাহিনি হিসাবে বেশ ভালো। তুলনামূলক পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে কেন আগে একটু পড়াশোনা করিনি, ভেবে রীতিমতো আপশোস হতে লাগল। এরকমই কিছু গল্প, যেমন এই প্রায়োরিতে নাকি রাতের বেলা পিশাচ এবং ডাইনিদের রীতিমতো জমায়েত হত এবং বাদুড়রূপী শয়তানের এক বিরাট বাহিনী সেই জমায়েত পাহারা দেওয়ার জন্য চারপাশ ঘিরে থাকত। প্রায়োরিকে ঘিরে-থাকা বিরাট বাগানটিতে যেসব অদ্ভুত ধরনের খড়খড়ে খোসার ফল চাষ হত, সেইসব নাকি ওই শয়তান বাদুড়বাহিনীর ক্ষুন্নিবৃত্তিতে কাজে লাগত। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক ছিল ইঁদুর নিয়ে এক নাটকীয় কাহিনি। পূর্বে বর্ণিত সেই কালান্তক ঘটনায় প্রায়োরি পরিত্যক্ত হবার প্রায় মাস তিনেক পর একরাতে নাকি কিলবিলে জঘন্য এই প্রাণীগুলোর এক বিরাট বাহিনী প্রায়োরি থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এদিক-সেদিক। এই নোংরা, হিংস্র এবং বুভুক্ষু শয়তানের দল নাকি পথে যা পেয়েছিল, সব কিছু গোগ্রাসে আত্মসাৎ করতে করতে এগোতে থাকে। মুরগি, শুয়োর, ঘোড়া, কুকুর, বেড়াল, এমনকী দুটি হতভাগ্য মানুষও এই রাক্ষুসে বাহিনীর পৈশাচিক খিদের শিকার হয় সেই অভিশপ্ত রাতে। এই ইঁদুরবাহিনীর নারকীয় কার্যকলাপের ওপর স্বতন্ত্রভাবে রচিত বা কথিত প্রচুর ভয়ানক গল্পকথা ছড়িয়ে আছে এই গ্রামের ঘরে ঘরে।