অ্যানচেস্টারে এসে উপস্থিত হলাম ডিসেম্বর নাগাদ। ক্যাপটেন নরিস আমাকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। গোলগাল, হাসিখুশি একটি ছেলে, সারাদিন অ্যালফ্রেডের কথাই বলতে থাকতেন। দেখলাম, বেশ আগে থেকেই দুই বন্ধু মিলে এই জায়গাটির ব্যাপারে অনেক তথ্য, নানা আশ্চর্য জনশ্রুতির সম্ভার আর প্ল্যান জোগাড় করে রেখেছে যেগুলো আমাকে এই অট্টালিকার সংস্কারসাধনে প্রচুর সহায়তা করবে। এক্সাম প্রায়োরিকে আমি এবার অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখলাম ভাঙাচোরা, মধ্যযুগীয় ধ্বংসস্তূপের গাদা জঞ্জালের মধ্যে অশ্বত্থা, ফার্ন গজিয়েছে। জায়গায় জায়গায় মৌচাক আর ঘুঘুর বাসা বিপজ্জনকভাবে এদিক-সেদিক থেকে ঝুলে আছে। ঘরের মেঝে এবং আসবাবের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। স্থানে স্থানে পাথর উঠে গিয়ে।
কয়েকদিন ভালো করে সরেজমিনে পরীক্ষা করার পর, প্রায় তিন শতাব্দী আগে জায়গাটা কীরকম ছিল, সে ব্যাপারে একটা ধারণা মোটামুটি স্পষ্ট হল। সেইভাবে হিসেব কষে আমি সংস্কারে নামলাম। মিস্ত্রি, শ্রমিক জোগাড় করা শুরু করলাম। প্রত্যেকটি কাজের ব্যাপারে আমাকে লোকালয়ের বাইরে যেতে হচ্ছিল, কারণ অ্যানচেস্টারের লোকজনদের মধ্যে দেখলাম জায়গাটার প্রতি এক অপরিসীম ভীতি এবং অবিশ্বাস্য ঘৃণা এখনও বর্তমান। এই আবেগটা এতই তীব্র ছিল, যে মাঝে মাঝে বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের মধ্যেও তা সঞ্চারিত হয়ে পড়ত আর যত রাজ্যের গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়ে কাজে ব্যাঘাত ঘটত। যত কুসংস্কার আর গুজব শুনতাম, সবই কিন্তু এই বাড়িটা এবং তাতে একদা বসবাসকারী আমার পূর্বপুরুষদের ঘিরেই।
আমার ছেলে একসময় আমাকে বলেছিল, যে, সে যখনই এখানে আসত, ডেলাপোর পরিচয় জেনে সবাই তাকে নাকি কেমন এড়িয়ে চলত। এহ বাহ্য– আমাকে তো এখানে প্রায় একঘরে করে দিয়েছিল লোকজন। আমি অতিকষ্টে ব্যাটাদের বিনীতভাবে বুঝিয়েছিলাম যে, আমি প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটতে আসিনি, কেননা সেসব ব্যাপারে আমার জ্ঞান ও মানসিকতা দুটোই অপর্যাপ্ত। আমি প্রবাসী, নেহাত পড়ে-পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো পূর্বপুরুষদের জমি-জায়গা হাতে এসেছে, তাই সংস্কার করে নিচ্ছি। দিনকাল যা পড়ছে– এরকম একটা জমকালো সম্পত্তি হাতছাড়া করা উচিত হবে না ইত্যাদি। এসব বোঝানোর পরও ওরা খুব যে আমাকে বিশ্বাস করেছে তা নয়– থেকে থেকেই সন্দেহের চোখে দ্যাখে। তাই যা কিছু জোগাড়পাতি করতে হয়েছে, সবই নরিসের মধ্যস্থতায়। পরে বুঝেছিলাম ওদের রাগের কারণ অন্য। আমি এমন এক স্থান সংস্কার করতে এসেছি, যেটার থেকে বেশি অভিশপ্ত এবং বিভীষিকাময় স্থান ওদের কাছে ও তল্লাটে কিছু নেই। পিশাচ এবং রক্তপায়ী শ্বাপদের বিচরণভূমি হিসাবেই ওরা জায়গাটাকে দেখে এসেছে এতদিন দূরে থেকেছে অপরিমিত ঘৃণা এবং আতঙ্কে।
বাড়িটা সম্বন্ধে যেসব গ্রাম্য গল্প বা কিংবদন্তি নরিস জোগাড় করে রেখেছিল, সেগুলোকে নিয়ে বসলাম। গল্পগুলোকে জুড়ে জুড়ে আর সেই সঙ্গে এই ধ্বংসস্তূপের ওপর নানা প্রামাণ্য লেখায় চোখ বুলিয়ে একটা থিয়োরি খাড়া করলাম। আমার যুক্তি অনুযায়ী, এখন যেখানে এক্সাম প্রায়োরি অবস্থান করছে, বহু শতাব্দী পূর্বে সেখানে একটা প্রাগৈতিহাসিক মন্দির ছিল। মন্দিরের বয়স বোধ করি স্টোনহেঞ্জেরৎ সমসাময়িক হবে। শোনা যায়, বেশ কিছু সুপ্রাচীন রহস্যময় তন্ত্রানুষ্ঠান ওখানে হত, যা নিয়ে কিছু অস্বস্তিকর রটনাও আছে। কথিত আছে, সেইসব আচার-অনুষ্ঠান নাকি শেষ অবধি ডাকিনী দেবী সিবেলের৫৪ আরাধনার রূপ নেয়। অট্টালিকার নীচের ঘরের চোরাকুঠুরিগুলিতে এখনও খোদাই করা আছে সেইসব পূজার মন্ত্র– দিভ… ওপাস… মাগনা– মাতে… মহাভৈরবীরূপিণী মহাদেবীর স্তুতি। রোমান আক্রমণের পর এইসব গুপ্তবিদ্যাচর্চা জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু গোপনে গোপনে এই ভয়ানক আদ্যাশক্তির সাধনা চলতেই থাকে। যত দূর জানা যায়, জুলিয়াস সিজারের আমলে অগস্টাস সেনাবাহিনীর তৃতীয় শাখাটি এই অ্যানচেস্টারেই শিবির স্থাপনা করেছিল। আরও কথিত আছে যে, দেবী সিবেলের অনিন্দ্যসুন্দর মন্দিরের পুরোহিতরা নাকি কোনও অজানা, গোপন তন্ত্রানুষ্ঠান করতেন এক ফ্রিজিয়ান প্রধান পুরোহিতের নেতৃত্বে। পরবর্তীকালে মূল ধর্মের মধ্যে নানা পরিবর্তন এলেও, ওই বিশেষ মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠান সেই প্রাচীন গোপনীয় এবং মধ্যযুগীয় রীতি অনুযায়ীই হত। রোমানদের পতনের পরে এই মন্দিরও নাকি কোনওভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তবে পরে স্যাক্সনদের প্রচেষ্টায় এর পুনঃসংস্কার ঘটে– আর এই স্থানটি হয়ে ওঠে সপ্তসাম্রাজ্যের সবচাইতে ভয়াল অঞ্চল। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের এক প্রাচীন পত্রিকায় দেখতে পেলাম, এই জায়গাটি নাকি দুনিয়ার পিশাচসিদ্ধ গুপ্তবিদ্যার সাধকদের এক আস্তানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল– আর এর চারপাশে ছিল ঘন গাছপালায় ঘেরা এক বাগান। পাথরে ঘেরা এই স্থানটিকে ঘিরে দিয়ে কোনও পাঁচিল না থাকলেও, এই অঞ্চলের শত মাইলের মধ্যে কেউ ভুলেও পা দিত না– এমনই কোনও এক অজানা আতঙ্কে মোড়া স্থান ছিল এটি। ড্যানিশদের আমলেও কেউ এই স্থানটির কোনও ক্ষতিসাধন করেনি, কিন্তু নরম্যানদের আগমনে স্থানটির মাহাত্ম্যের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। রাজা তৃতীয় হেনরি শেষ অবধি জায়গাটি আমাদের ঊর্ধ্বতন আদিপুরুষ গিলবার্ট ডেলাপোরের হাতে তুলে দেন, ঘটনাচক্রে তিনিই ছিলেন এক্সাম অঞ্চলের প্রথম ব্যারন– আর সালটা ছিল ১২৬১।