আমার পরিবারের অতীত ইতিহাস বেশ অদ্ভুত। যে রহস্য নিয়ে আমার পূর্বপুরুষ সুদূর অ্যানচেস্টার থেকে ভার্জিনিয়ার কলোনিতে এসে নতুনভাবে জীবন শুরু করেন, সে ব্যাপারে ডেলাপোর বংশ কিন্তু নিশ্চিদ্র মন্ত্রগুপ্তি বজায় রেখে চলেছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও এই রহস্যের বিশেষ কিছুমাত্র উদ্ধার করে উঠতে পারিনি। আমাদের পাড়া প্রতিবেশীদের মতো আমরা কিন্তু নিজেদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করা বা বহু বছর আগে তাদের নায়কোচিত কার্যকলাপের বিবরণ দিয়ে ছাতি দশ হাত করে ফেলার মতো কিছুই করিনি, বরং নিজেদের পরিবারের ইতিহাসের বিষয়ে বিশেষ কিছু না-জানার জন্য চুপ করে থাকতে হয়েছে অধিকাংশ সময়েই। বংশানুক্রমে কিছু সংস্কার, আদবকায়দা বা আচার-বিচার ইত্যাদি আদিপুরুষ থেকে উত্তরপুরুষের ওপর হস্তান্তরিত হয়, কিন্তু সেখানেও ভাঁড়ে মা ভবানী! কেবল আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ বাধার সময়ে, আমার পূর্বপুরুষ সেই রহস্যময় ভদ্রলোক, একটি মুখবন্ধ খামে কিছু লিখে তাঁর বড় ছেলের হাতে সঁপে দিয়ে যান এবং নির্দেশ দেন, খামের মুখ যেন তাঁর মৃত্যুর পরেই খোলা হয়। সঠিকভাবে বলতে গেলে, আমাদের বংশের গৌরবের সূচনাই ঘটেছে, আমার পূর্বপুরুষের এই দেশান্তরকরণের পর থেকেই। তবে এটা ঠিক যে, পরবর্তীকালে এক সম্মানজনক বংশের মর্যাদা আমরা লাভ করেছিলাম, তবুও সবাইকে এড়িয়ে চলার মতো অসামাজিকতা এবং তদুপরি চাপা স্বভাবটা যেন আমাদের বংশের রক্তের মধ্যে ভীষণভাবে ঢুকে গিয়েছিল যতই তাতে ভার্জিনীয় মিশ্রণ থাকুক না কেন।
যা-ই হোক, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় ভাগ্যদেবতা আরও একবার আমাদের ওপর বিমুখ হলেন। কারফ্যাক্স পতনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বসংকট দেখা দিল। আমাদের বাড়িটা ছিল জেমস নদীর ধারেই। উন্মত্ত জনতা যখন সেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন সেখানে আমার দাদু উপস্থিত ছিলেন। সেই ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের তিনি বলি হন, আর সেই সঙ্গে তাঁর বাবার দেওয়া বিশেষ খামটি, যা ছিল আমাদের পরিবারের রহস্যময় অতীতের এক চরম গোপনীয় দলিল সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। আজ, এত দিন পরেও সেই দিনটির কথা আমার স্মৃতিতে দগদগ করছে। তখন আমার সাত বছর বয়স। পুলিশের চিৎকার, মহিলাদের বিলাপ, নিগ্রোদের বুকফাটা আর্তি– সব মিলিয়ে সে রাতটা আমার মন থেকে কোনও দিনই মুছে যাবার নয়। আমার বাবা তখন মিলিটারিতে, রিচমন্ডের হয়ে লড়ছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমি আর মা শেষ পর্যন্ত বাবার সঙ্গে যোগ দিতে পেরেছিলাম। যুদ্ধ শেষ হবার পর আমরা সপরিবারে উত্তরের দিকে যাত্রা করি। এভাবেই ধীরে ধীরে আমি বড় হলাম, মধ্যবয়সে পৌঁছোলাম, এবং শেষ পর্যন্ত এক কর্তব্যপরায়ণ ইয়াঙ্কিতে পরিণত হলাম। যদিও আমার বাবা, আমি– কেউই জানতে পারিনি যে, সেই খামের মধ্যে কী লেখা ছিল।
ম্যাসাচুসেটসে ফিরে আমি নিজের ব্যাবসার ব্যস্ততায় ডুবে গেলাম, আর রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে প্রতিদিন মোলাকাতের ফলে, সুদূর অতীতে কোনও একসময়ে আমার পরিবারের এক প্রাচীন রহস্যের প্রতি আগ্রহ আমার মন থেকে ক্রমশ হারিয়ে গেল। যদি সেই সময় কোনওভাবেও আন্দাজ করতে পারতাম!! তাহলে এক্সাম প্রায়োরিকে এরকম ইঁদুর বাদুড়ের আস্তানাই থাকতে দিতাম জীবনে কোনও দিনই এই অভিশপ্ত এলাকায় পা রাখতাম না।
১৯০৪ সালে আমার বাবা মারা গেলেন। না, আমার জন্য না, আমার মা-হারা ছেলে অ্যালফ্রেডের জন্য, আমাদের পরিবারের এই প্রাচীন রহস্যের ওপর তিনি কোনও সূত্রই রেখে গেলেন না। আমার ছেলেই কিন্তু পরবর্তীকালে আমাদের প্রায় বিস্মৃত পরিবারের আদি ইতিহাস ঘেঁটে বের করেছিল। আমি ওকে বানিয়ে বানিয়ে কিছু গল্প বলেছিলাম বটে ওর ছোটবেলায়, তবে সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল আমার কল্পনা। ১৯১৭ সালে আমার ছেলে এভিয়েশন অফিসার হয়ে লন্ডনে যায়। আর সেখান থেকে আমাদের পরিবারের ব্যাপারে খুব আশ্চর্যজনক কিছু খবর আমাকে লিখে পাঠিয়েছিল। পড়ে জানতে পারলাম, ডেলাপোরদের জীবন একসময় যেমন বর্ণময়, ঠিক ততখানিই অভিশপ্ত ছিল। আরও জানলাম, আমার ছেলের এক বন্ধু, ক্যাপটেন নরিস, আমাদের পুরোনো ভিটের নিকটবর্তী গ্রাম অ্যানচেস্টারের বাসিন্দা। তার থেকেই এসব খবরের সন্ধান পেয়েছে। অ্যালফ্রেড। তা ছাড়া সে নরিসের গ্রামের বাড়িতে গিয়েও থেকেছে। সেখানে আমাদের আদি পরিবারের ব্যাপারে গ্রাম্য লোকমুখে যা কুসংস্কার এবং কিংবদন্তি যুগযুগান্তর ধরে ছড়িয়েছে, সেটা বড় বড় লেখকের গল্প-উপন্যাসকেও হার মানাবে। যদিও নরিস নিজেও এসব গালগল্পের খুব কমই বিশ্বাস করে, তবুও এই গল্পগুলি আমার ছেলে অ্যালফ্রেডের কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক লেগিয়েছিল, সন্দেহ নেই। বলতে দ্বিধা নেই, এই জনশ্রুতিগুলিই কিন্তু সুদূর অতলান্তিক পারের পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল। অ্যালফ্রেড লিখেছিল যে, নরিসের কাকাই এখন ওই সম্পত্তির মালিক। আমার ছেলের পরিচয় জেনে তিনি খুব কম দামে ওই জমি-বাড়ি আমাকে বিক্রি করে দিতে রাজি হলেন। অদম্য কৌতূহলে, আমিও নরিস ছেলেটির সাহায্যে আমাদের হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হলাম।
১৯১৮ সালে এক্সাম প্রায়োরি আমি কিনে নিলাম। কিন্তু সংস্কারের কাজে নামা তখনই সম্ভব হল না। যুদ্ধ থেকে আমার ছেলে পঙ্গু হয়ে ফিরে এল, আর আমার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হল আমার ছেলের শুশ্রূষার ব্যাপারে। পরবর্তী যে দুটি বছর অ্যালফ্রেড বেঁচে ছিল, আমি ওর সেবা ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। নিজের ব্যাবসার কাজও আমার পার্টনারদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। আলফ্রেড মারা যাবার বছরখানেক পর, ১৯২১ সাল নাগাদ, নিজেকে এতটাই রিক্ত এবং লক্ষ্যহীন মনে হতে লাগল, যে সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে নতুন-কেনা সম্পত্তির সঙ্গে সময় কাটানোই মনস্থ করলাম। মনে হল, একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে হয়তো এই চরম একাকিত্ব আর দুঃখ ভুলে থাকা যাবে।