যেসব প্রাণীর চিন্তাভাবনা ইথরা বন্দি করত, তারা প্রথমে খুব ভয় পেত বা আশ্চর্য হয়ে যেত, কিন্তু পরে অভ্যস্ত হয়ে যেত ইথদের দুনিয়ায়। যেমন হয়েছিলাম আমি যা-ই হোক, সে কথায় পরে আসছি। যদিও তাদের এই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া সম্পূর্ণভাবে ইথদের ইচ্ছা অনুযায়ীই হত। বন্দিরা এরপর রাক্ষুসে উড়োজাহাজ বা পারমাণবিক ইঞ্জিনওয়ালা বোটে করে যেত ইথদের লাইব্রেরিতে। সেখানে তাদের বিভিন্ন গ্রহের অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চর্চা করতে দেওয়া হত। এরপর অনেক বন্দি একজোট হয়ে লেগে পড়ত পৃথিবীর গোপন সব রহস্যভেদে। অতীতের বহু হারানো অধ্যায় আর সুদূর ভবিষ্যতের অগ্রগতি দেখে তারা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যেত।
অনেক সময় হয়তো ভবিষ্যৎ থেকে বন্দি হয়ে আসা কারও সঙ্গে জ্ঞানের আদানপ্রদান হত। তারপর তাদের কাজ হত নিজেদের ভাষায় বিভিন্ন যুগের ওইসব নথি ইথদের লাইব্রেরিতে জমা করা। কোনও কোনও বন্দি অবশ্য কিছু বাড়তি সুবিধা পেত। তবে তারা সংখ্যায় ছিল খুবই কম। মুমূর্ষ এইসব বন্দিকে পাঠানো হত চিরনির্বাসনে। তার অবশ্য কারণও ছিল। ভবিষ্যতে এদের কায়িক অবয়ব হয়তো কোনও ইথের হাতে বন্দি৷ ইথরা খুব সম্ভবত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল, তাই মানসিক অবলুপ্তির হাত থেকে মুক্তির জন্যই তাদের এই ফন্দি। তবে এই ঘটনার সংখ্যা ছিল খুবই কম। বন্দি মন যখন তার ভবিষ্যতের ইচ্ছা জানতে পারত, তখন একটা যন্ত্রের সাহায্যে সে এই গোটা পদ্ধতিটাই উলটোদিকে চালাত। ফলে ভবিষ্যতে সঠিক শরীরে সে ফিরে যেতে পারত। অবশ্য শরীর নষ্ট হয়ে গেলে এটা সম্ভব ছিল না। তখন ওই মন হয় কোনও ভিনগ্রহীর আকার ধারণ করত, আর না-হয় চিরকালের মতো বন্দি হয়ে থাকত ইথিয়ান জগতে। অবশ্য বন্দি-হওয়া মন যদি কোনও ইথের হত তাহলে ব্যাপারটা এতটা ভয়ানক হত না। নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে ইথরা যথেষ্ট সচেতন ছিল। যখন কোনও ভিনগ্রহী প্রজাতির বন্দি মন তার নিজের শরীরে ফিরে যেত, তখন যান্ত্রিকভাবে হিপনোসিসের মাধ্যমে ইথিয়ান দুনিয়ার যাবতীয় জ্ঞান ও স্মৃতি মুছে ফেলা হত। এর কারণ অবশ্যই ভবিষ্যতের ঝামেলা এড়ানো। পৃথিবীতে বিভিন্ন বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে এগুলোই ওইসব পুঁথিতে উল্লেখ করা আছে। অবশ্য এই সব কিছুই যুগযুগান্ত দূরের ঘটনা, যার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে সমুদ্রের গভীরে। কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে ভয়ানক প্লাকোটিক পাণ্ডুলিপিতে। ইথিয়ান দুনিয়া থেকে যেসব মন চিন্তন তরঙ্গের মাধ্যমে নিজের শরীরে ফিরে আসত, ওই জগতের ছিটেফোঁটা স্মৃতিও তার থাকত না। সব পুরোপুরি মুছে দেওয়া হত।
যেসব সংগঠন গুপ্তবিদ্যাচর্চার সঙ্গে জড়িত, তারা অবশ্যই এই ব্যাপারগুলো খুব ভালোভাবে জানত। নেক্রোনমিকন-এ তো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির কথা, যারা কালসমুদ্রে ইথিয়ান দুনিয়ায় পাড়ি জমাত। ইথরা শুধু পৃথিবীই নয়, আরও বিভিন্ন গ্রহে চিন্তন আর মনন আদানপ্রদানের কাজ শুরু করেছিল। খুব সম্ভবত ইথরা নিজেদের সেই উৎসের সঙ্গে কালচক্রকে মেলাতে পেরেছিল, যার শুরু হয়েছিল সেই বিগ ব্যাং-এর আমলে। ইথদের শরীরের থেকেও তাদের মানসিক বয়স ছিল বহু প্রাচীন। শরীরী অবয়ব তারা অনেক পরে লাভ করে। নিজেদের বিলুপ্তির কথা জানতে পেরেই তারা তাদের চিন্তনকে ভবিষ্যৎ দুনিয়ায় পাঠাতে চেয়েছিল কয়েক লক্ষ-কোটি বছর আগে, এবং সফলও হয়েছিল।
১৯২০ সাল নাগাদ আমি আমার জট-পাকানো চিন্তাভাবনাগুলোকে একটা ঠিকঠাক জায়গায় আনতে পেরেছিলাম। আমার ওই উদ্বেগ আর উত্তেজনাও অনেক কমে গিয়েছিল। আমি আস্তে আস্তে আমার স্মৃতিবিভ্রাটের সময়ের ঘটনাগুলোকে এক সুতোয় বাঁধতে চাইছিলাম। ওই সময় আমি যে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতাম বা ওই হায়ারোগ্লিফিক চিহ্নগুলো স্বপ্নে দেখতাম, নিঃসন্দেহে ওইসব পুঁথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার ফল। আমার অবচেতন মনে ব্যাপক ছাপ পড়ার ফলেই ওগুলো ঘটত। আমি এই সময় বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছিলাম এইসব বিষয় নিয়ে কিন্তু কোনও কূলকিনারাই পাইনি।
নানা সময়ে আমি যে কেসগুলো ঘেঁটেছিলাম, প্রথম প্রথম আমার সঙ্গে রুগিদের মিল দেখে প্রচণ্ড ভয় পেতাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, ওইসব পুঁথিতে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা নেহাত উপকথারই শামিল, কারণ এখনকার সময়ের থেকে অতীতের সঙ্গেই ওগুলোর মিল বেশি। আমার আগে যাদের এরকম ঘটেছিল, খুব সম্ভবত স্মৃতিবিভ্রাটের পর তারা তাদের পারিপার্শ্বিক কিছু চালু ধারণার সঙ্গেই নিজেদের জড়িয়ে ফ্যালে, তারপর সেখান থেকে বেরোতে না পেরে নিজেদের কল্পনাতেই এক অমানবিক জগৎ বানিয়ে সেখানে পাড়ি জমায়। আমার ক্ষেত্রে এগুলো হয়নি, কারণ আমি এগুলো নিয়ে চর্চা আরম্ভ করি প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার পরে। আমার আগের রুগিদের স্মৃতিশক্তি ফিরে এলেও ওই কাল্পনিক দুনিয়া থেকে তারা আর বেরোতে পারেনি। আমি আমার মনে কখনওই এইসব চিন্তাভাবনাকে গেড়ে বসতে দিইনি। সবসময় যুক্তি-পালটা যুক্তি দিয়ে ভাবতাম। পরে বিভিন্ন নামকরা মনোবিদ আর নৃতত্ত্ববিদও আমার সঙ্গে একমত হন।
যা-ই হোক, আমি কিন্তু ওইসব ভূতুড়ে স্বপ্ন আর চিন্তাভাবনার থেকে আত্মরক্ষার বেশ ভালো একটা উপায় ঠাওরেছিলাম। রাতে যদি কোনও অদ্ভুত স্বপ্নও দেখতাম, বুঝতাম, ওইসব পুঁথিপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার ফলেই আমার অবচেতন মনে ওগুলোর ছাপ পড়েছে। এই থিয়োরিটা বেশ কাজে দিয়েছিল। আমার স্নায়ুতন্ত্রেও একটা স্থিতিশীলতা আসে। ১৯২২ সাল নাগাদ আমি বুঝতে পারলাম, আবার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারব। এবং নতুন যা যা কিছু শিখেছি, সেগুলো হাতেকলমে প্রয়োগের এটাই সেরা উপায়। এই সময় আমি তাই ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। এদিকে অধ্যাপনার পাশাপাশি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য আমার মেজ ছেলে উইনগেটও এই সময় ইউনিভার্সিটিতে এল। আমাদের দুজনের জুটিতে আরও অনেক দূর এগোতে পারব ভেবে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল।