যেহেতু আমার দ্বৈত সত্তা তখন খবরের কাগজে একটা আলোচিত বিষয় তাই অনেক লাইব্রেরিয়ান আমার ধোঁয়াশা কাটাতে এটাও বলল যে, ওই চিহ্নগুলো আমি নিজেই অচেতনভাবে আমার দ্বৈত সত্তার প্রভাবে ঘোরের মধ্যে এঁকে ফেলেছি। তাদের ধোঁয়াশা কাটাবার ঠ্যালায় আমার ঘিলু আরও ঘেঁটে গেল। এইসব নথিপত্র ঘেঁটে একটা কথা সার বুঝলাম, এইসব গুপ্তবিদ্যায় ব্যবহৃত তিনটে ভাষা সম্পর্কে আমার কোনওরকম ধারণা নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান আর নৃতত্ত্বের পুরোনো আর নতুন সমস্ত নথি থেকে বিভিন্ন ছড়ানো ছিটোনো তথ্য এক জায়গায় করে দেখলাম, এগুলো অধিকাংশই অলীক আর প্রচলিত কিছু ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্যালেওজোইক, মেসোওজোইক, জুরাসিক, ট্রায়াসিক যুগের কিছু ছবি তুলে ধরেছে। আমি এটা ভেবে স্বস্তি পেলাম যে, ১৭ থেকে ২৫০ লক্ষ বছর আগের পৃথিবীর কিছু উপকথামার্কা থিয়োরি নিয়ে হয়তো সত্যিই তেমনভাবে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু এগুলোর বীভৎসতা আমার মাথার মধ্যে পোকার মতো কিলবিল করতে লাগল। এত পুরোনো দিনের ঘটনা শুধু ধোঁয়াশাই বাড়ায়। কিন্তু স্বীকার করতে বাধা নেই, আর সবার মতো আমিও ওই অজানা আদিম আতঙ্ককে ভয় পেতে লাগলাম। যুগে যুগে এইসব উপকথায় একটু একটু করে রং চড়েছে, আর সেটা আমার মতো স্মৃতিবিভ্রাটের রুগির চিন্তনের জগতে একটা কাল্পনিক দুনিয়া তৈরি করে তালুক গেড়ে বসেছে। আমি নিজেই তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
আবার কিছু কিছু উপকথা, বিশেষ করে কিছু হিন্দু পুরাণে মানবসভ্যতার সৃষ্টির আগে থেকে কালচক্রে কী করে আধুনিক ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে, তার উল্লেখ আছে। এসব পড়লে যে কোনও লোক শিউরে উঠবে বা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যাবে, কিন্তু আমি ক্রমশ এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। পুরাণ আর বিভ্রান্তি সব কিছুর সারসংক্ষেপ থেকে এটা প্রমাণিত যে, এই পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে যতই রহস্য থাকুক, মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে সব ঝড়ঝাপটা অতিক্রম করে শুধু টিকেই থাকেনি, সারা দুনিয়ায় তার আধিপত্য কায়েম করেছে। কিন্তু ওইসব পুরাণে এ কথাও উল্লেখ আছে, মানুষ সৃষ্টির তিনশো কোটি বছর আগেই এক প্রজাতি মেঘলোক থেকে হাজির হয়ে আয়ত্ত করেছিল এই প্রকৃতির সমস্ত রহস্য। তাদের আকার, প্রকৃতি কোনও কিছু নিয়েই ওইসব বইয়ে কোনও উল্লেখ ছিল না। তাদের কেউ কেউ হয়তো এসেছিল আমাদের এই মহাবিশ্ব বা তার থেকেও প্রাচীন কোনও নক্ষত্রলোক থেকে। আর খুব দ্রুতভাবে সৃষ্টি করেছিল জীবনচক্রের সেই প্রথম জীবাণু। সৃষ্টির হাজার-লক্ষ বছরের বিবর্তনে আমরা যে জিনিসটাকে সময় বলে মেনে নিয়েছি, আদপে নাকি তার কোনও অস্তিত্বই নেই!!
কিন্তু এ ছাড়াও ওইসব পুরাণে অপেক্ষাকৃত নবীন এক প্রজাতির কথা বলা হয়েছে। জটিল আর বীভৎস আকৃতির ওই প্রজাতির তথাকথিত বিজ্ঞানের আলোকে পরিচিত কোনও আকার ছিল না। এরা মানুষ সৃষ্টির পঞ্চাশ কোটি বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু তার মধ্যেই এরা আয়ত্ত আর জয় করে ফ্যালে সময়ের সেই গোপন রহস্য। আর সেই জন্যই এদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে ওইসব পুরাণে উল্লেখ করা আছে। এই পৃথিবীর ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের যাবতীয় জ্ঞান এদের আয়ত্তে চলে আসে। নিজেদের তীব্র মানসিক ক্ষমতা দিয়ে তারা অনায়াসে চলে যেত অতীত কিংবা বর্তমানে। এবং সেই সময়ের সমস্ত জ্ঞান পুরোপুরি আয়ত্তে নিয়ে আসে। এমনকী মানবসভ্যতার যাবতীয় পুরাণও ছিল তাদের নখদর্পণে!! এদের একটা কেতাবি নামও অবশ্য উল্লেখ আছে ওইসব বইয়ে–ইথ! ইথদের বিশালাকার লাইব্রেরিতে এই পৃথিবীর বছরের পর বছরের সমস্ত প্রজাতির শিল্প, ভাষা, মনোবিজ্ঞান, কৃতিত্ব– সব কিছুর সচিত্র বিবরণ ঠাসা থাকত। ইথরা প্রত্যেক যুগ থেকেই নিজেদের স্বভাব আর পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই কাউকে বেছে নিত। ভূত ভবিষ্যৎ-বর্তমানের এই জ্ঞান তাদের আয়ত্তে থাকার ফলে তাদের কোনও সমস্যাই হত না। পরবর্তীকালে উপযুক্ত যন্ত্র এসে যাওয়ার ফলে এদের কাছে এই কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। তখন ইথরা অনায়াসে তাদের সময়-ভ্রমণে ইচ্ছেমতো যুগে নিজেদের সশরীরে হাজির করতে পারত। প্রাথমিক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবার পর এরা সেই যুগের সেরা প্রজাতিকে বেছে নিত। তারপর তাদের কাজ ছিল চিন্তন তরঙ্গের মাধ্যমে সেই জীবের মস্তিষ্কে নিজেদের ভাবনাকে চালান করা। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে জীবের মগজে ওই ভাবনাপ্রবাহের আমদানি হত, সময়চক্রের এক বিপরীত প্রবাহের সৃষ্টি হত তার শরীরে। সে তখন সেই ইথদের উত্তরসূরি ছাড়া কিছুই নয়। তার কাজ হত বেছে নেওয়া যুগের যাবতীয় তথ্য আর কারিগরি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিখে নেওয়া। ব্যাপারটা এমনি ভাবলে হয়তো বেশ মজা লাগবে, যেন চাহিদা আর জোগানের খেলা। কিন্তু এরপর যেটা হত, সেটা আরও ভয়ংকর। ইথরা তাদের পরীক্ষার গিনিপিগের চিন্তন আর মননকে ফিরিয়ে আন্ত নিজেদের যুগে এবং নিজেদের শরীরে। তারপর যত্ন নিয়ে সেগুলো রক্ষা করত। এইভাবেই ছোট প্রজাতির সঙ্গে ভরের আদানপ্রদান ঘটিয়ে ইথরা নিজেদের অস্তিত্ব লোপকে ঠেকিয়ে রাখত আর হয়ে উঠত সর্বজ্ঞ। কোনও প্রজাতির ভাষা তাদের অজানা থাকলেও, তাদের কাছে এমন যন্ত্র ছিল, যা দিয়ে তারা অনায়াসে ওই ভাষার অনুবাদ করে ফেলতে পারত। ইথদের চেহারার বর্ণনাও দেওয়া ছিল কিছু বইয়ে। ইথরা আকারে ছিল প্রায় দশ ফুট লম্বা। দেখলে মনে হবে ঠিক যেন শঙ্কু আকৃতির কিছু কুঁজো হয়ে রয়েছে। ওই শঙ্কু আকৃতির ধড়ের ওপর থাকত মাথা। সেই মাথা থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ছড়িয়ে থাকত। তারা কথা বলত তাদের বিশাল আকারের গুঁড় দিয়ে ক্লিক ক্লিক শব্দ করে। চলাফেরার দরকার হলে স্যাঁতস্যাঁতে জেলির মতো ওই দশ ফুটের অবয়বকে হড়কে হড়কে নিয়ে যেত এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায়।