টাওয়ারগুলোর ওপরটা ছিল গোলাকার আর তাতে মোমবাতির মতো একটা ক্ষীণ আলো দেখা যেত৷ টাওয়ারগুলোতে কোনও দরজা বা জানলা দেখতে পেতাম না। এ ছাড়াও কিছু ছোট ছোট ভাঙাচোরা বাড়ি দেখতে পেতাম। দেখলে মনে হত, অগুনতি বছর ধরে ওগুলো একইভাবে রয়েছে। অবশ্য দেখতে ছোটখাটো হলেও, ওগুলো দেখে ওই বন্ধ দরজাগুলোর মতোই ভয় পেতাম।
আবার আসি ওই বাগানের কথায়, যেগুলো দেখলেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত নেমে যেত। বারবার বাগান বলছি, কারণ ওখানে নানারকম অদ্ভুত ফুলবিহীন ছত্রাকের মতো ফ্যাকাশে গাছপালা দেখতাম। আর ছিল সব কিছুকে টেক্কা-দেওয়া পাম গাছের মতোই দেখতে একটা ভূতুড়ে গাছ। ক্যালামাইটের পেল্লায় ওই গাছ থেকে নেমে-আসা শুড়গুলো দেখলে আবার মনে হত বাঁশ গাছ। এ ছাড়াও ছিল পাহাড়ি এলাকার মতো কিছু ঝোপঝাড় আর গাছপালা। কিছু কিছু বাড়ির ছাদের বাগান থেকে আবার কিছু দানবীয় ছত্রাক বাড়ির গা বেয়েই নেমে আসত। দেখলে মনে হবে যেন গিলে খেতে আসছে। তবে কোথাও কোথাও আবার শৌখিন টপিয়ারি ধাঁচের গাছও দেখা যেত। বাগান, বাড়ি, রাস্তা যেমনই হোক, আকাশ সবসময় মেঘলা থাকত। কোনও কোনও সময় প্রবল বৃষ্টি হতেও দেখেছি। শুধু একবার বোধহয় সূর্যের মতো কোনও কিছুর একটা ঝলকানি দেখেছিলাম। সূর্যের মতো বললাম, কারণ সূর্যের থেকে আকারে ওটা ছিল অনেক অনেক বড়। রাতের আকাশ খুব কমই বুঝতে পারতাম। একবার কিছু তারা দেখতে পেলেও ভালো করে বুঝতে পারিনি। মনে হত, আমি যেন পৃথিবীর এক অজানা গোলার্ধে রয়েছি।
১৯১৪-র অক্টোবর মাসের পর থেকে কিছু খাপছাড়া স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমি দেখতাম, আমি যেন একটা শহরের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি। সেই শহর, যেখানে আমার ওই আতঙ্কপুরীও ছিল। ওপর থেকে নানা রঙের জঙ্গল দেখতে পেতাম। ওই জঙ্গলগুলোর এক-একটা গাছ এতটাই বড় ছিল যে, দেখলে শিউরে উঠতাম। আমার বন্দিনিবাস আতঙ্কপুরী যে শহরে ছিল, তার আশপাশেও আরও অদ্ভুত দেখতে কিছু শহর দেখতাম। একবার তো মাইলের পর মাইল জোড়া ব্যাসাল্ট পাথরের ধ্বংসাবশেষও দেখেছিলাম। সব থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার হল, ওই ব্যাসাল্টগুলোর গায়েও নকশা আর কারিগরির মতো দেখেছিলাম, ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম আতঙ্কপুরীর দেওয়ালে! আর একবার ওই গম্বুজের ধারেই ধীরস্থির, স্রোতহীন এক সমুদ্র দেখেছিলাম।
আমি আগেও বলেছি, যেসব দৃশ্যের ঝলক আমি দেখতাম, তার থেকে ঢের বেশি ভয়ের স্বপ্ন অনেকে দেখে থাকেন। এবং একটা সময় আমি এগুলোকে স্বাভাবিক বলে মেনেও নিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, ওই ঘটনার আগে কস্মিনকালেও আমি স্বপ্নবিলাসিতা করিনি। বরং স্বপ্ন নিয়ে এযাবৎ যা যা তর্ক চালিয়েছি, সবই ছিল কিছু মান্ধাতার আমলের পুঁথিগত বিদ্যার প্রতিফলন। কয়েক মাস পর থেকেই কিন্তু গল্প আর এক রইল না। যা যা স্বপ্ন দেখতাম, তার প্রায় সবটাই স্মৃতির মধ্যে থেকে যেত; ফলে আমার মনের ভেতর জমে-থাকা ভয় এক নারকীয় আকার ধারণ করল। শুধু তা-ই নয়, আমার মগজ ওই দুঃস্বপ্নের সঙ্গে আমার সচেতন অবস্থায় থেকে দেখা ঝলকগুলোকে মেলাতে শুরু করল। আমি পরিষ্কার বুঝলাম, ১৯০৮ থেকে ১৯১৩– এই সময়ের মধ্যে আমার যে দ্বিতীয় সত্তার সৃষ্টি হয়েছে, তার কাছে আমার ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলি নামক সত্তাটা সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে।
ইতিমধ্যে আমার দুঃস্বপ্নে অনেক খুঁটিনাটি তথ্য আসতে শুরু করেছে, ফলে ভয়াবহতা বেড়ে গিয়েছিল কয়েকশো গুণ। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, আমার কিছু করা উচিত, কিন্তু আদপে আমার কিছুই করার ছিল না। ১৯১৫-র অক্টোবর মাসের আগে পর্যন্ত এই স্বপ্ন তথা দুঃস্বপ্নের জাল বিছোনোর পর্ব চলল বেশ ভালোভাবেই। এরপরেই আমি বিস্মৃতি আর দৃষ্টিবিভ্রমের ওপর বিভিন্ন কেস ঘাঁটতে শুরু করলাম। গবেষণার উদ্দেশ্য একটাই, যদি ওই দ্বিতীয় সত্তাকে হারিয়ে ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলিকে জেতানো যায়! আগেই বলেছি, এতে ফল হয়েছিল বিপরীত! আমার মনে এমন ধারণাও আসতে শুরু করেছিল যে, এইসব গবেষণার ফলেই হয়তো আমার অবচেতন মনে তার ছাপ পড়ছে এবং ফলস্বরূপ ওই দুঃস্বপ্ন। কারণ ওইসব কেস ঘেঁটে দেখলাম, আগের অধিকাংশ ব্যক্তিরই ভূতত্ত্ব সম্পর্কে না ছিল কোনও জ্ঞান আর ওই কেসগুলোতে তারা ঠিক কী ধরনের দৃশ্য দেখত, সে সম্পর্কেও ছিল না কোনওরকম উল্লেখ। যেটুকু ছিল তা থেকে বুঝলাম, এরা বিভিন্ন অতিকায় বাড়ি, জংলা বাগান ইত্যাদি দেখত। আর একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো ছিল, এদের সবাই ধর্মবিরোধিতা করতে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বসেছিল। সব থেকে জঘন্য ব্যাপার, ইতিমধ্যে আমার ওই দ্বিতীয় সত্তা ক্রমাগত আমাকে ওইসব ভয়ংকর স্বপ্ন আর বিভিন্ন ঘটনার পূর্বাভাস দেখিয়ে চলেছিল। আর এদিকে বিভিন্ন ডাক্তারবাবু আমার কেসটাকে দ্বৈত সত্তার আদর্শ কেস হিসেবে মেনে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে আমি আমার মেজ ছেলে উইনগেটের ব্যাপক উৎসাহে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করে দিয়েছিলাম। উইনগেটও অবশ্য অধ্যাপনার পাশাপাশি একই কাজ করছিল। ১৯১৭-১৮ সাল নাগাদ আমি মিসকাটনিকে স্পেশাল কোর্সও করেছিলাম। ইতিমধ্যে আমার চিকিৎসাবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, ইতিহাসের হরেকরকম নথি ঘাঁটার রোজনামচায় আরও একটা ব্যাপার যোগ হল, সেটা হচ্ছে আমার ওই দ্বিতীয় সত্তার যেসব বিষয়ে প্রবল উৎসাহ যেমন গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত যতরকম বই আছে, দূরদূরান্তের লাইব্রেরিতে গিয়ে সেগুলো নিয়ে চর্চা করা। এক-একটা বই এতই বীভৎস ছিল যে, আমি নিজেও শিউরে উঠেছিলাম। শুধু এটুকুই বলছি, আমি আমার দ্বিতীয় সত্তার প্রভাবে যেসব বীভৎসতার মুখোমুখি হয়েছিলাম, এগুলোর বীভৎসতা ছিল তার থেকে অনেকটাই বেশি। কিছু কিছু বইয়ের আধুনিক সংস্করণে আমি কিছু শব্দ আর বাগধারার পরিবর্তন দেখলাম, কারণ মূল শব্দগুলো এতটাই বীভৎস ছিল যে, কোনও আধুনিক সভ্যতা ওগুলোকে মেনে নেবে না। বইগুলো নানা ভাষায় লেখা হলেও কিছু কিছু চিহ্ন সব বইয়েই দেখেছিলাম। আর আমার ধারণা, যাঁরা এই সংশোধনের কাজ করেছিলেন, মূল শব্দগুলোর অর্থ তাঁদের অজানা ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, ভন জানৎসের লেখা আনঅসপ্ৰেলিচেন কাল্টেন বইটার কথা। এতে যে হায়ারোগ্লিফিক মার্কা সাংকেতিক চিহ্নগুলো ছিল, সেগুলোর সঙ্গে কোনও পার্থিব চিহ্নের কোনওরকম মিল নেই। কিন্তু সব থেকে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, ওই চিহ্নগুলো যে কালিতে আঁকা ছিল, সংশোধনও করা হয়েছে একই কালিতে!! তাহলে লেখক আর সংশোধক কি একই লোক? তিনি কি জানতেন, এই বই সঠিক হাতে না পড়লে কী কী বিপর্যয় হতে পারে? এই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকে কোনও আসন্ন অপার্থিব বিপর্যয় থেকে বাঁচাবার জন্যই কি এই সংশোধন করা হয়েছে? বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। আর সব থেকে পিলে চমকে দেবার মতো বিষয় হল, হায়ারোগ্লিফিক মার্কা সাংকেতিক চিহ্নগুলোকে যখন আমি চিনতে পারলাম না, ওগুলোর মানে বুঝতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু ওই চিহ্নগুলোই যে আমার স্বপ্নে ঘুরে-ফিরে আসত, সে বিষয়ে আমার আর সন্দেহ ছিল না।